বিসর্জনের রাতে বিষণ্ন পশ্চিবঙ্গের শারদোৎসব

প্রশান্তি আন্তর্জাতিক ডেক্স॥ প্রতিমা নিরঞ্জন দেখতে গত  বুধবার রাতে পশ্চিবঙ্গের জলপাইগুড়ি জেলার মাল নদীর ঘাটে গিয়েছিলেন মালবাজারের হাজার পাঁচেক বাসিন্দা। সে সময়ই ঘটলো বড় বিপর্যয়। হড়পা বানের জেরে বিপুল জলস্রোতে ভেসে গেলেন বহু মানুষ। তাদের মধ্যে দুই শিশুসহ অন্তত আট জনের মৃত্যু হয়েছে। গত  বৃহস্পতিবার সকালে মৃতদের উদ্ধার করা হয়। নিখোঁজ এখনও প্রায় ৩০ জন। গত  বৃহস্পতিবার বিকাল পর্যন্ত ১৩ জনকে উদ্ধার করা সম্ভব হয়েছে। বর্তমানে তারা মালবাজার হাসপাতালে ভর্তি। এদিকে গত  বৃহস্পতিবার দুপুর থেকে এনডিআরএফ উদ্ধার কাজ চালাচ্ছে জোরকদমে। আশঙ্কা করা হচ্ছে, আরও বাড়তে পারে মৃতের সংখ্যা। 

এলাকার বাসিন্দারা জানান, সপ্তমী, অষ্টমীর আকাশ পরিষ্কার থাকলেও নবমীর দিন থেকে শুরু হয় মালবাজার শহরসহ আশেপাশের এলাকায় বৃষ্টি। দশমীতে সকাল থেকে আকাশ পরিষ্কারই ছিল। বিকাল হতেই মাল নদীতে প্রতিমা নিরঞ্জন ঘাটে বিসর্জন শুরু হয়। সন্ধ্যা পর্যন্ত কোনও বিঘ্ন হয়নি। এক এক করে আশেপাশের আইভিল, সোনগাছি, বাতাবাড়ি চাবাগানসহ মালবাজার শহরের কয়েকটি প্রতিমা নির্বিঘ্নে বিসর্জন হয়। সন্ধ্যা নামতেই ভিড় বাড়ে। এক এক করে ঘাটে আসতে শুরু করে শোভাযাত্রাসহ দেবী প্রতিমা। কিন্তু রাত সাড়ে আটটা নাগাদ আচমকাই রুদ্ররূপ ধারণ করে মালনদী। পাহাড়ের ওপর থেকে ধেয়ে আসে হড়পা বান। সেই বানের তোড়ে ভেঙে যায় প্রশাসনের তৈরি করা বালির বাঁধ। এতেই প্রতিমা ভাসাতে আসা কয়েকটি গাড়ি ও কয়েকশ মানুষ নদীর স্রোতের মুখে পড়ে যায়। ভেসে যায় বেশ কিছু মানুষ ও প্রতিমা নিরঞ্জনের ট্রাক। উদ্ধারকারী দল বেশ কিছু মানুষকে উদ্ধার করলেও ভেসে যান অনেকে। বেশ কয়েকজনকে আনা হয় মাল সুপার স্পেশালিটি হাসপাতালে।

সর্বশেষ খবর অনুযায়ী, এ পর্যন্ত ৮ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। মৃতরা হলেন- তপন অধিকারী (৭২), উর্মি সাহা (১৩), রুমুর সাহা (৪২), আনস পণ্ডিত (৮), বিভা দেবী (২৮), শুভাশিস রাহা (৬৩), সুস্মিতা পোদ্দার (২২), শোভনদীপ অধিকারী (২০)।

প্রত্যক্ষদর্শীদের বয়ান-হড়পা বানে হাত পা ভেঙে আহত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি রয়েছেন এক নারী। তার কথায়, আমাদের পরিবার থেকে আমি একাই বিসর্জন দেখতে গিয়েছিলাম। সেই সময় ঘাটে বিসর্জন দেখার জন্য বহু মানুষের ভিড় ছিল। আচমকা দেখি ব্যাপক জলের স্রোত সবকিছু ভাসিয়ে নিয়ে চলে গেলো। আমিও জলের স্রোতে ছিটকে পড়েছিলাম। পরে ক্রেন এসে আমাকে উদ্ধার করে। জ্ঞান ফিরলে দেখি আমার হাত-পা ভাঙা অবস্থায় রয়েছে।

মালবাজার সুপার স্পেশালিটি হাসপাতালে ভর্তি রয়েছেন সেখানকার আরও এক বাসিন্দা হুসেন। তিনি বলেন, যখন সবাই ভেসে যাচ্ছিল তখন আমি একটি শিশুর হাত কোনোভাবে ধরতে পেরেছিলাম। কিন্তু, জলের স্রোত এতই বেশি ছিল যে তাকে আর বেশিক্ষণ ধরে রাখতে পারলাম না। সে কোথায় ভেসে গেল কী জানি!

ঘটনাস্থলে সরকার ও বিরোধী দলীয় নেতারা গত বুধবার রাতেই ঘটনাস্থলে আসেন জলপাইগুড়ির সাংসদ ড. জয়ন্ত রায় ও বিজেপি জেলা সভাপতি বাপি গোস্বামী। পাশাপাশি মাল হাসপাতালে গিয়ে আহতদের সঙ্গে দেখাও করেন তারা।

এদিকে উত্তরবঙ্গ উন্নয়মন্ত্রী উদয়ন গুহ, শিলিগুড়ির মেয়র গৌতম দেবসহ অন্যান্যরা গত বৃহস্পতিবার মালবাজারে আসেন। ঘটনাস্থল পরিদর্শনের পাশাপাশি আহতদের সম্পর্কেও খোঁজ নেন তা। গৌতম দেব বলেন, জেলা প্রশাসন নিখোঁজদের অনুসন্ধানে তল্লাশি চালাচ্ছে। নবান্ন থেকে গোটা ঘটনার রিপোর্ট চেয়ে পাঠানো হয়েছে।

দায় কার?

বিসর্জনে এই প্রাণহানির দায় কার? এই প্রশ্নই এখন ওঠে আসছে। দুর্ঘটনাকে কেন্দ্র করে শুরু হয়েছে রাজনৈতিক চাপানউতোর। পাহাড়ি মাল নদীর গতিপ্রকৃতি প্রায় সবারই জানা। এই নদীত হড়পা বানে বড় বড় লরি ভেসে যাওয়ার ঘটনা আকছার ঘটে। গত মাসে ওই নদীতে এক লরি চালক ও খালাসি এধরণের হড়পা বানের কবলে পড়েন। নদীতে নেমে লরি ধোয়া-মোছার কাজ করার সময় আচমকাই হড়পা বান আসে। কোনোক্রমে প্রাণে বাঁচেন গাড়ির চালক ও খালাসি। 

প্রশ্ন ওঠছে, যেখানে আবহাওয়া দফতরের আগাম সতর্কতা ছিল দার্জিলিং ও জলপাইগুড়ি জেলায় ভারী বৃষ্টি হবে, তবু নদীর বুকে এইভাবে কেন বিসর্জনের আয়োজন করা হলো? 

স্থানীয়দের অভিযোগ, জেসিবি দিয়ে মাটি খুঁড়ে মাল নদীতে একটি চর তৈরি করা হয়েছিল। যাতে সেই চরে বাধা পেয়ে একটি খাতে বেশি জল বইতে পারে এবং তাতে সহজেই বিসর্জন দেওয়া যায়। কিন্তু বাধা পাওয়াতেই জলের গতি বেশি বেড়ে যায় বলে তাদের অভিযোগ। প্রশাসনের বিরুদ্ধে আরও অভিযোগ, নদীর পাড়ে দাঁড়িয়ে বিসর্জন দেখার কথা। কিন্তু নদীর চরে কেন বাঁশের কাঠামো তৈরি করে লাইট লাগানো হয়েছিল? ওই লাইট লাগানোর ফলেই মানুষজন নদীগর্ভে নেমে পড়েন।

প্রশাসনের বক্তব্য মালবাজার প্রশাসনের দাবি, নিষেধ করা সত্ত্বেও মানুষ নদীতে নেমে যায়। দুর্ঘটনার পর অবশ্য প্রশ্ন ওঠেছে, গত বুধবার রাতে বিসর্জনের জন্য এত মানুষকে নদীতে নামতে দেওয়া হলো কেন? কয়েক হাজার মানুষ জড়ো হলেও কেন পর্যাপ্ত সিভিল ডিফেন্সকর্মী ঘটনাস্থলে ছিলেন না? দুর্ঘটনার পর উদ্ধার শুরু করতেই বা ঘণ্টাখানেক সময় লেগে গেলো কীভাবে? মালবাজার সিভিল ডিফেন্সের কর্মকর্তা পল্লব বিকাশ মজুমদার বলেন, মাত্র ৮ জন সিভিল ডিফেন্সের কর্মী ছিল এই মাল নিরঞ্জন ঘাটে। পর্যাপ্ত যন্ত্রপাতিও ছিল না তাদের কাছে। বৃষ্টির কারণে উদ্ধার কাজ ব্যহত রয়েছে। 

পুলিশ সুপার দেবর্ষি দত্ত জানান, গত বুধবার রাতে আচমকাই বান এসেছে। পুলিশের তরফে সব রকমের ব্যবস্থা নেওয়া ছিল। মেডিক্যাল টিম, পৌরসভার লোক, পুলিশ কর্মী মোতায়েন ছিল। যখন বিসর্জন শুরু হয় তখন এক হাঁটু জল ছিল। কিন্তু হঠাৎ রাত সাড়ে আটটা নাগাদ হড়পা বান আসে। তাতে প্রচুর মানুষকে ভাসিয়ে নিয়ে যায়। সেই সময় প্রায় ১ হাজার মানুষ ছিলেন নদীর বুকে। ঘটনার পর কারও পরিবারের পক্ষ থেকে কেউ মৌখিক বা লিখিতভাবে নিখোঁজের কোনও অভিযোগ করেননি। ২০-২৫ জন ভেসে গিয়েছিল। সবাইকে উদ্ধার করা হয়েছে। তাই মনে হয় না আর কেউ ভেসে গিয়েছে।

প্রশাসনের বিরুদ্ধে তোপ বিজেপির প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি মালবাজারের এই ঘটনায় শোক প্রকাশ করেছেন। মৃতদের জন্য তার দফতর থেকে ২ লাখ রুপি ও আহতদের জন্য ৫০ হাজার রুপি ক্ষতিপূরণের ঘোষণা হয়েছে। রাজ্য সরকারও ক্ষতিপূরণের ঘোষণা করে গত বৃহস্পতিবার থেকেই মন্ত্রীদের হাত দিয়ে চেক বিলি শুরু করেছে। তবে এই ঘটনায় প্রশাসনের ব্যর্থতাকেই দায়ী করছেন বিজপি নেতারা। স্থানীয় বিজেপি নেতা মনোজ টিগগা বলেন, শুকনো নদীতে বোল্ডার দিয়ে বাধ দেওয়া কারণে এই তীব্র জলস্রোত তৈরি হয়। স্থানীয় পৌরসভা ও প্রশাসন আগাম সচেতন হলে এই দুর্ঘটনা এড়ানো যেত।

আলিপুরদুয়ারের বিজেপি সাংসদ জন বারলা বলেন, স্থানীয় মানুষ উদ্ধার কাজে তৎক্ষণাৎ নামতে চেয়েছিল। কিন্তু পুলিশ তাদের লাঠিচার্জ করে বাধা দেয়। এদিকে নিজেরাও দুর্ঘটনাগ্রস্তদের উদ্ধারে কোনও ভূমিকা নেয়নি। পুলিশ নদীর ধারে দাঁড়িয়ে থেকে শুধু বিপর্যয় ঘটতে দেখেছে। ভেসে যাওয়া মানুষকে উদ্ধারে কর্তব্যরত পুলিশ ও সিভিল ডিফেন্স কর্মীদের যে যথেষ্ট গাফিলতি ছিল, তা আমাদের নজরে এসেছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published.