১৯৭১ সালের সোহরাওয়ার্দীর আত্মসমর্পণ ও শর্ত

প্রশান্তি ডেক্স॥ গতকালই উদযাপীত হয়েছে মহান বিজয় দিবস। এদিনটি হচ্ছে বাঙালি জাতির জীবনে চিরঅম্লান, চিরস্মরণীয়। দিনটি গর্ব আর অহংকারের। এদিন আত্মপ্রকাশ করে বাংলাদেশ। সেদিন ছিল বৃহস্পতিবার। কিছু শর্ত মেনে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী আত্মসমর্পণে রাজি হয়েছিল। আর যে উদ্যানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঐতিহাসিক ভাষণের মধ্য দিয়ে স্বাধীনতার বাণী শুনিয়েছিলেন, সেই উদ্যানেই দীর্ঘ ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের সমাপ্তি ঘোষণা শেষে পৃথিবীর মানচিত্রে জন্ম হয় বাংলাদেশের।

সেদিন সকাল থেকেই ছড়িয়ে পড়তে থাকে আত্মসমর্পণের কথা। ততক্ষণে অগ্রসরমান মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় জওয়ানদের সম্মিলিত অভিযানে বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা নগরী মুক্ত হয়েছে এবং সব সরকারি-বেসরকারি ভবনে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উড্ডীন হয়েছে। তাঁবেদার গভর্নর মালেকের পদত্যাগের পর খান সেনারা নিজেরাই যুদ্ধ বিরতির আর্জি জানায়।

মুক্তিযোদ্ধারা বলছেন, তখনও সবাই ঢাকায় ঢুকতে পারেননি। তারপরও বীর মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় জওয়ানরা পাকিস্তানি ও হানাদারদের পশ্চাৎধাবন করে মহানগরী ঢাকায় প্রবেশ করলে, বিরান ও ধ্বংসস্তূপ নগরী যেন প্রাণ ফিরে পেতে শুরু করে। পাকিস্তানি সৈন্যবাহিনীর প্রধান ভারতের জেনারেল মানেকশের কাছে যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব জানালে ভারতের সেনাপতি তাদের আত্মসমর্পণের নির্দেশ দেন।

তখন ৪টা বেজে ৩১ মিনিট : বাংলাদেশের স্বাধীনতার দলিলপত্রে ইউএনআই-এ প্রকাশিত সংবাদের উল্লেখ আছে। সেখানে বলা হয়, পাকিস্তানি দখলদার বাহিনী আজ  বিনা শর্তে মুক্তিবাহিনীর সহযোগী ভারতীয় সৈন্যবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করায় গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ পূর্ণ মুক্তিলাভ করলো। আত্মসমর্পণের নথিপত্রে সই করেন পাকিস্তানি বাহিনীর প্রধান লে. জে. নিয়াজী এবং ভারতীয় ইস্টার্ন কমান্ডের জিওসি ইন সি লে. জে. জগজিৎ সিং অরোরা। লে. জে. অরোরা এই উদ্দেশ্যে সেদিন দুপুরে বিমানযোগে বাংলাদেশের রাজধানীতে আসেন। বিকাল ৪টা ৩১ মিনিটে এই নথি সই হয়।

কোথায় ছিলেন তখন প্রশ্নে মুক্তিযোদ্ধা ডা. এম হাসান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমি বিজয়ের ঠিক আগে আগে আখাউড়ার অপারেশনে নেতৃত্ব দিচ্ছিলাম। ১৩ তারিখ ঢাকায় বুড়িগঙ্গার পাড়ে আসি এবং শহরে ঢোকার চেষ্টা করি। কিন্তু আমাদের কাছে নির্দেশ আসে পিছিয়ে যাওয়ার। পরে ১৬ তারিখ আমাদের ঢাকায় ঢোকার অনুমতি মিলে। আমরা হেঁটে ঢুকছিলাম। পাকিস্তানি সেনারাও ঢুকছিল সেই সময়। তাদের হাতের অস্ত্র মাটির দিকে নামানো ছিল। আমাদের ওপর নির্দেশনা ছিল—কোনোরকম হতাহতের ঘটনা যেন না ঘটে। মজার ব্যাপার হলো, আমরা সোহরাওয়ার্দী পর্যন্ত যেতে পারিনি। এত ক্লান্ত ছিলাম, স্টেডিয়াম পর্যন্ত এসে ঘুমিয়ে পড়ি। তার পরের কয়েক দিন ঢাকার আইনশৃঙ্খলার দায়িত্ব পালন করতে হয়েছে। যেখানে গেছি, মানুষ আমাদের জয় বাংলা স্লোগান দিয়ে বরণ করে দিয়েছে। সেসময় পাকিস্তানি সৈন্যদের ফেলে যাওয়া অস্ত্র ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল বেশ কিছু জায়গায়। অতি উৎসাহী সাধারণ জনগণ সেই অস্ত্র দিয়ে কিছু গোলাগুলির ঘটনা ঘটায়। সেটি যেন মাত্রা না ছাড়ায় সেটা আমাদের দেখতে হয়েছে।

কী শর্তে হলো আত্মসমর্পণ?: ১৬ ডিসেম্বরের আগের কয়েক দিনের আলোচনার মধ্য দিয়ে সিদ্ধান্ত হয়, জেনেভা চুক্তি মেনেই হানাদার বাহিনীকে সুরক্ষিত রাখা হবে।

পাকিস্তানি বাহিনীর লে. জে. নিয়াজী ভারতীয় বাহিনীর লে. জে. অরোরার কাছে প্রদত্ত যে আত্মসমর্পণপত্রে সই করেন তাতে বলা হয়, আত্মসমর্পণ যারা করেছে তাদের মধ্যে আছে পাকিস্তানি স্থল, বিমান, নৌবাহিনীসহ প্যারামিলিটারি বাহিনী ও অসামরিক সশস্ত্র বাহিনীর সব সৈনিক। এসব বাহিনীর সৈনিকেরা যে যেখানে আছে, সেখানে লে. জেনারেল অরোরার অধীন সৈন্যবাহিনীর কাছে অস্ত্র ও আত্মসমর্পণ করবে। এই নথি সইয়ের সঙ্গে সঙ্গেই পাকিস্তানি ইস্টার্ন কমান্ড লে. জেনারেল অরোরার অধীন হয়ে যাবে।

এই আদেশ যে অবজ্ঞা করবে তাকে আত্মসমর্পণ শর্তের পরিপন্থি বলে মনে করা হবে এবং যুদ্ধের প্রচলিত নিয়মানুযায়ী তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। আত্মসমর্পণ শর্তাবলি সম্পর্কে কোনও সন্দেহ দেখা দিলে লে. জেনারেল অরোরা সে বিষয়ে যে ব্যাখ্যা করবেন, তাকেই চূড়ান্ত বলে বিবেচনা করা হবে। লে. জেনারেল অরোরা এই প্রতিশ্রুতি দেন যে, যেসব সৈন্য আত্মসমর্পণ করবে, তাদের প্রত্যেকের সঙ্গে জেনেভা চুক্তির শর্ত অনুযায়ী সম্মান ও মর্যাদাযুক্ত ব্যবহার করা হবে এবং তাদের নিরাপত্তার সব ব্যবস্থা অবলম্বন করা হবে।

জয় বাংলা উচ্চারণে প্রকম্পিত চারপাশ : ৪৭ বছর আগে এই দিন ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) বর্বর পাকিস্তানি বাহিনী হাতের অস্ত্র সমর্পণ করে বীর বাঙালির সামনে। সই করে তারা পরাজয়ের সনদে। দীর্ঘ ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর পরাজয় মেনে নিতে বাধ্য হয়েছিল হানাদাররা।

ভাটারা এলাকার মুক্তিযোদ্ধা মোজাম্মেল হক সেদিনের স্মৃতি হাতড়ে বলেন, ‘‘আমরা যখন ঢুকছি, তখন ভারতীয় বাহিনী সামনে ঢুকে পড়েছে। সে কী উৎসাহ মানুষের মধ্যে। কোনও ভয় ছাড়া ঢাকার রাজপথে নেমে এসেছে সবাই। তবে তখনও বেশিরভাগ মুক্তিযোদ্ধা ঢাকায় পৌঁছাতে পারেনি। ১৬ তারিখের পরের এক সপ্তাহজুড়ে শহরে প্রবেশ করতে থাকে মানুষ। পথে পথে মানুষ যখনই মুক্তিযোদ্ধাদের দেখেছে তখনই ‘জয় বাংলা’ স্লোগান দিয়ে পরস্পরকে শুভেচ্ছা জানিয়েছে।’’

Leave a Reply

Your email address will not be published.