বিশ্ব হার্ট দিবসের প্রতিপাদ্যে অতিরিক্ত লবণ ডেকে আনে হার্টের বিপদ

প্রশান্তি ডেক্স ॥সাধারণ নিয়মে প্রতিদিন খাবারের সঙ্গে আমরা লবণ গ্রহণ করি। চিকিৎসকদের মতে, দিনে খাবারের সঙ্গে এক চামচ পরিমাণ লবণ গ্রহণ করা যায়। তবে এর বেশি হলে ডেকে আনবে মারাত্মক বিপদ। বাসায় তৈরি খাবারের পাশাপাশি প্যাকেটজাত খাবারেও ঝুঁকি বাড়ছে। কারণ, গবেষকরা এসব খাবারে নিরাপদ মাত্রার চেয়েও বেশি লবণ পেয়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, অতিরিক্ত লবণ খেলে রক্তে সোডিয়ামের মাত্রা বেড়ে যায়, যা স্ট্রোক এবং হার্ট (হৃদপিন্ড) অ্যাটাকের মতো রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়। তাই উচ্চ রক্তচাপ এবং হাইপারটেনশনে আক্রান্ত রোগীসহ সবাইকে অতিরিক্ত লবণ খাওয়া কমাতে হবে। রান্নায় পরিমিত লবণই যথেষ্ট, খাবারে আলাদা করে লবণ দেওয়ার প্রয়োজন নেই।

গত শুক্রবার ছিল বিশ্ব হার্ট দিবস। প্রতি বছর ২৯ সেপ্টেম্বর এ দিবসটি পালন করা হয় হার্টের বিষয়ে মানুষকে সচেতন করার উদ্দেশে। এ বছর দিবসটির প্রতিপাদ্য ‘ইউজ হার্ট, নোউ হার্ট’, বাংলায় যার অর্থ দাঁড়ায় ‘ভালোবাসা দিয়ে প্রতিটি হৃদয়ের যত্ন নিন।’

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশে প্রতি বছর মোট মৃত্যুর ৬৭ শতাংশ সংঘটিত হয় অসংক্রামক রোগের কারণে। হৃদরোগ, ক্যানসার, ডায়াবেটিস, কিডনি রোগ, শ্বাস রোগের মতো এসব অসংক্রামক রোগে প্রতিবছর দেড় কোটি মানুষ মারা যায়, যাদের বয়স ৩০ থেকে ৬৯-এর মধ্যে। এই অকাল মৃত্যুর ৮৫ শতাংশই নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশগুলোতে ঘটে। বাংলাদেশও এরমধ্যে উল্লেখযোগ্য।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষণা অনুযায়ী, দেশে কম বয়সী হৃদরোগীর সংখ্যা বাড়ছে। উন্নত বিশ্বের তুলনায় এই হার ১৭ গুণ বেশি। বাড়ছে অল্প বয়সে মৃত্যুও। অল্প বয়সে ধূমপান, মদ্যপান, কোলেস্টেরল ও চর্বিযুক্ত খাবার খাওয়া, অনিয়ন্ত্রিত জীবনযাপন, ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হওয়া এর অন্যতম কারণ বলে মনে করেন গবেষকরা।

ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশনের আরেক গবেষণা প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, অত্যধিক লবণযুক্ত প্যাকেটজাত খাবারে হৃদরোগী বাড়ছে। যুক্তরাষ্ট্রের ‘রিজলভ টু সেভ লাইভসের’ সহায়তায় ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন পরিচালিত ‘অ্যাসেসমেন্ট অব সল্ট কনটেন্ট অ্যান্ড লেবেল // কমপ্লায়েন্স অব কমনলি কনজিউমড প্রোসেসড প্যাকেজড ফুডস অব বাংলাদেশ’ শীর্ষক এক গবেষণায় এ তথ্য উঠে এসেছে।

গবেষণার তথ্য বলছে, প্রতি ১০০ গ্রাম খাবারে সর্বোচ্চ ৭৫০ মিলিগ্রাম পর্যন্ত লবণকে নিরাপদ মাত্রা বিবেচনায় নিয়ে দেখা গেছে, বাজারে বহুল প্রচলিত ৬১ শতাংশ বিস্কুট, চিপস, চানাচুর, নুডলস, ইনস্ট্যান্ট স্যুপ, ঝালমুড়ি, আচার, চাটনি ইত্যাদি প্রক্রিয়াজাত প্যাকেট খাবারে নিরাপদ মাত্রার চেয়ে বেশি লবণ পাওয়া গেছে। আর ৩৪ শতাংশ খাবারে নিরাপদ মাত্রার দ্বিগুণ অর্থাৎ ১ দশমিক ৫ গ্রামের বেশি লবণ পাওয়া গেছে।

এছাড়া, চানাচুর, নুডলস, ইনস্ট্যান্ট স্যুপ ও ঝালমুড়ির কোনোটিতেই নির্ধারিত মাত্রার লবণ পাওয়া যায়নি, বরং এগুলোতে দ্বিগুণের বেশি লবণ রয়েছে। একইভাবে চাটনিতে ৮৩ শতাংশ, চিপসে ৬৩ শতাংশ এবং ডাল ও বুট ভাজার ৬০ শতাংশে দ্বিগুণ লবণ রয়েছে বলে গবেষণায় প্রমাণ মিলেছে।

গবেষকদের মতে, দেশের ৯৭ শতাংশ মানুষই এ জাতীয় খাবার খেয়ে থাকে। অতিমাত্রায় লবণ গ্রহণের ফলে উচ্চ রক্তচাপ, হৃদরোগ, স্ট্রোক ও কিডনি রোগের ঝুঁকি অনেক বেড়ে যায়। আর এসব রোগ প্রতিরোধ করতে হলে প্রক্রিয়াজাত খাবারে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্দেশনা অনুসারে লবণের পরিমাণ নির্ধারণ করতে সরকারকে উদ্যোগ নিতে হবে। পাশাপাশি খাদ্যপণ্যের প্যাকেটে পুষ্টি সম্পর্কিত তথ্য যথাযথভাবে উল্লেখ করতে হবে।

ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশনের গবেষক ডা. তামান্না আফরোজ বলেন, ‘বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা প্রতিদিন পাঁচ গ্রাম লবণ গ্রহণের পরামর্শ দেয়। একজন সুস্থ মানুষের দিনে এক চা চামচের কম লবণ খাওয়া উচিত। না হলে উচ্চ রক্তচাপ, কিডনি, হার্টের জটিলতা দেখা দিতে পারে। কিন্তু বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত যত সার্ভে হয়েছে, সবখানেই দেখা গেছে বাংলাদেশের মানুষ গড়ে কমপক্ষে ১০ গ্রাম লবণ খায়। ছোটবেলায় আমরা প্রক্রিয়াজাত খাবারের মধ্যে শুধু চিপস আর চানাচুর খেতাম। এখন অনেক রকম পণ্য বাজারে পাওয়া যায় এবং সহজলভ্য। এখান থেকেও আমরা অনেকখানি লবণ গ্রহণ করি।’ 

গবেষকদের মতে, হৃদরোগ বিশ্বের এক নম্বর ঘাতক রোগ। বিশ্বের প্রায় ৬২ কোটি মানুষ হৃদরোগে আক্রান্ত। সম্প্রতি নতুন এক গবেষণায় উঠে এসেছে, প্রতি দেড় সেকেন্ডে বিশ্বব্যাপী একজন রোগীর মৃত্যু হচ্ছে হার্ট অ্যাটাকে। এ রকম চলতে থাকলে ২০৩০ সালে মৃত্যুর হার বেড়ে বছরে ২ কোটি ৩০ লাখ মানুষ মারা যাবে হৃদরোগের কারণে।

বিএসএমএমইউ’র ইন্টারভেনশনাল কার্ডিওলজি বিভাগের অধ্যাপক ও বাংলাদেশ কার্ডিওভাস্কুলার রিসার্চ ফাউন্ডেশনের সভাপতি এস এম মোস্তফা জামান জানান, বাংলাদেশে পুরুষের চেয়ে নারীদের হৃদরোগে আক্রান্তের হার বেশি। এ অঞ্চলের মানুষের ঝুঁকি বেশি হৃদরোগের কারণে। বিএসএমএমইউ এবং আমার নিজের করা একটি গবেষণায় এসেছে, যাদের বয়স ৩৫-এর নিচে, তাদের হৃদরোগের ঝুঁকি উন্নত বিশ্বের তুলনায় ১৭ গুণ বেশি। তাই হৃদরোগের ব্যাপারে সবার সচেতন হওয়া দরকার।

ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালের কার্ডিওলোজি বিভাগের প্রধান অধ্যাপক আবদুল ওয়াদুদ চৌধুরীর মতে, বাংলাদেশে দিন দিন হৃদরোগীর সংখ্যা বেড়েই চলেছে। বংশগত কারণ ছাড়াও অনিয়মিত জীবনযাত্রা, খাদ্যাভ্যাস, কম শ্রম, ভুল ডায়েট, দুশ্চিন্তা ইত্যাদি নানা কারণে হৃদরোগীর সংখ্যা বেড়েই চলেছে। বংশগত কারণকে কোনও পরিবর্তন করা না গেলেও উল্লিখিত প্রতিটি কারণকে পরিবর্তন বা সংশোধন করে হৃদরোগের ঝুঁকি অনেক কমানো সম্ভব।

চিকিৎসকদের মতে, বুকে ব্যথা বা ধড়ফড় করা, মাথা ঘোরানো, শ্বাস নিতে সমস্যা, ক্লান্তি, গ্যাস হওয়া, ঘেমে যাওয়া, ইত্যাদি দেখা গেলে অবহেলা না করে দ্রুত নিকটস্থ চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।

তিনি বলেন, ‘প্রথমে জনসচেতনতা বাড়ানো প্রয়োজন। ঝুঁকি এড়াতে পর্যাপ্ত ঘুম, ব্যায়াম করার সঙ্গে নিয়মিত স্বাস্থ্যকর খাবারও খেতে হবে। জাংক ফুড বা চর্বিযুক্ত খাবার বেশি খাওয়া, ধূমপান ও মদ্যপানের অভ্যাসের কারণে কম বয়সেই হার্ট অ্যাটাক হয়ে থাকে।’

Leave a Reply

Your email address will not be published.