প্রধানমন্ত্রীর আগামী ইউরোপ সফরের তাৎপর্য

প্রশান্তি ডেক্স ॥ ইউরোপ সফরে যাচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সবকিছু ঠিক থাকলে আগামী ২৫ ও ২৬ অক্টোবর ব্রাসেলসে অনুষ্ঠেয় গ্লোবাল গেটওয়ে ফোরামের প্রথম সম্মেলনে অংশ নেবেন তিনি। ইন্দো-প্যাসিফিককে কেন্দ্র করে ভূ-রাজনীতি, বৈশ্বিক তহবিল সংগ্রহের বিকল্প ব্যবস্থা ও আঞ্চলিক সহযোগিতাসহ অন্যান্য কারণে এই সফরটি খুব তাৎপর্যপূর্ণ।

এবারের সফরে ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের শীর্ষ নেতৃত্ব ও অন্যান্য নেতার সঙ্গে ইউরোপের ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশল নিয়ে বাংলাদেশের আলোচনার সুযোগ তৈরি হবে। এছাড়া ইউরোপিয়ান ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংক থেকে বাংলাদেশের নবায়ন জ্বালানি খাতে সহজ শর্তে ৩৫০ মিলিয়ন ইউরো ঋণ পাওয়ার বিষয়টি চূড়ান্ত রূপ পেতে পারে। বিশেষজ্ঞদের মতে এ সফরটি সফল হলে বাংলাদেশের আঞ্চলিক সংযোগ ও বৈশ্বিক তহবিল সংগ্রহের ক্ষেত্রে বড় ধরনের পরিবর্তন আসতে পারে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে সাবেক পররাষ্ট্র সচিব ও দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের বঙ্গবন্ধু চেয়ার মো. শহীদুল হক বলেন, ‘ইউরোপের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ আমরা সবসময় বজায় রেখেছি। আমার বিবেচনায় এবারের সফরে গুরুত্ব হচ্ছে-প্রথম গ্লোবাল গেটওয়ে ফোরামে অংশ নেওয়ার মাধ্যমে বাংলাদেশ বার্তা দিচ্ছে, ইউরোপের যে বৈশ্বিক আকাঙ্খা তার সঙ্গে কাজ করতে আগ্রহী সরকার। এটি একদিকে যেমন বাংলাদেশের জাতীয় স্বার্থ সংরক্ষণে সহায়ক হবে, অন্যদিকে এ অঞ্চলে ইউরোপের লক্ষ্য অর্জনে বাংলাদেশকে অংশীদার হিসাবে পাশে পাবে তারা।’

তিনি বলেন যে ইউরোপের যে ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশল রয়েছে সেটি অর্জনে সহায়ক ভূমিকা পালন করে গ্লোবাল গেটওয়ে। এ অঞ্চলকে কেন্দ্র করে ইউরোপের আগ্রহের ম্যাপে বাংলাদেশকে তারা অংশীদার হিসাবে পেতে চাইবে, এটি স্বাভাবিক।

গ্লোবাল গেটওয়ে কী: গ্লোবাল গেটওয়ে হচ্ছে ইউরোপের নতুন একটি কৌশল যা ২০২১ সালে শুরু হয়। এর অধীনে ২০২৭ পর্যন্ত ইউরোপ ৩০০ বিলিয়ন ইউরো ব্যয় করবে পাঁচটি অংশীদারত্ব খাতে-ডিজিটাল, জলবায়ু পরিবর্তন ও জ্বালানি, পরিবহন, স্বাস্থ্য এবং শিক্ষা ও গবেষণা।

এর মূল নীতি ছয়টি এবং সেগুলো হচ্ছে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ, সুশাসন ও স্বচ্ছতা, সমান অংশীদারত্ব, সবুজ ও পরিষ্কার সমাজ, নিরাপত্তা জোরদার ও বেসরকারি খাতকে সম্পৃক্তকরণ।

ওই ৩০০ বিলিয়ন ইউরো আফ্রিকা, ল্যাটিন আমেরিকা ও এশিয়ার বিভিন্ন প্রকল্পে বিনিয়োগ করা হবে। অনানুষ্ঠানিকভাবে অনেকে গ্লোবাল গেটওয়েকে চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোডের ইউরোপীয় ভার্সন হিসেবে অভিহিত করে থাকে। এরমধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে ইউরোপের ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশল অর্জনের জন্য ওই অর্থের একটি অংশ ব্যয় করবে ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন এবং সেখানেই বাংলাদেশের গুরুত্ব। এজন্য ইউরোপিয়ান ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংককে ব্যবহার করবে ইইউ।

কোভিড মহামারির সময়ে বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাতে অংশীদারত্বের হাত বাড়িয়ে দেয় ইউরোপ এবং এর অংশ হিসাবে ২৫০ মিলিয়ন ইউরো সহায়তা দেওয়া হয়। এবারে জলবায়ু পরিবর্তন ও জ্বালানি খাতে সহায়তার জন্য সহজ শর্তে ৩৫০ মিলিয়ন ইউরো দিতে রাজি হয়েছে ইউরোপিয়ান ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংক।

এখানে লক্ষণীয় যে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় বহুপাক্ষিক ঋণদাতা ইউরোপিয়ান ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংকের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক ২০০০ সাল থেকে। ব্যাংকটি থেকে প্রথম ২০ বছরে বাংলাদেশ সহায়তা পেয়েছে ৭৫০ মিলিয়ন ইউরো। কিন্তু গত দুই বছরে ব্যাংকটি সহায়তা দিতে রাজি হয়েছে ৬০০ মিলিয়ন ইউরো। এখান থেকে বোঝা যায় ইউরোপের আগ্রহী খাতে বাংলাদেশ অংশীদার হতে চায়, এই বার্তাটি সঠিকভাবে তাদের দেওয়া হয়েছে।

তহবিল সংগ্রহের বিকল্প ব্যবস্থা: ইউরোপিয়ান ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংক বিশ্বের সবচেয়ে বড় বহুপাক্ষিক ঋণদাতা হলেও বাংলাদেশের সঙ্গে তাদের অংশীদারত্ব কম। বাংলাদেশ মূলত বিশ্ব ব্যাংক, এডিবি, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়াসহ অন্যান্য জায়গা থেকে সহজ শর্তে ঋণ নিয়ে থাকে। ইআইবি থেকে কম ঋণ নেওয়ার অন্যতম কারণ হচ্ছে এটির সুদের হার বাজারভিত্তিক। ২০২৬ সালের পরে স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে বের হয়ে যাওয়ার পরে বাংলাদেশের পক্ষে সহজ শর্তে ঋণ পাওয়া মুশকিল হয়ে যাবে। ফলে তহবিল সংগ্রহের বিকল্প ব্যবস্থা হিসাবে ইউরোপিয়ান ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংক সামনের দিনগুলোতে গুরুত্ব পাবে।

এ বিষয়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা বলেন, ইউরোপের সঙ্গে আমাদের বড় দুটি অংশীদারত্বের জায়গা হচ্ছে বাণিজ্য ও উন্নয়ন সহযোগিতা। এর বাইরে নতুন একটি সহযোগিতার ক্ষেত্র তৈরি করার চেষ্টা করা হচ্ছে এবং সেটি হচ্ছে তহবিল সংগ্রহ।

বাংলাদেশের বিভিন্ন মেগা প্রকল্পে অর্থায়নের জন্য যেসব দ্বিপক্ষীয় ও বহুপাক্ষিক ব্যবস্থার ওপর বাংলাদেশ নির্ভরশীল, তার বাইরে গিয়ে ইআইবির সঙ্গে আরও ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রক্ষা করবে সরকার বলে তিনি জানান।

তিনি বলেন, ‘বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়নে বাংলাদেশের তহবিল প্রয়োজন এবং জাতীয় স্বার্থ সংরক্ষণ করে যেখান থেকে কম খরচে তহবিল পাওয়া যাবে, সেখান থেকেই সংগ্রহ করা হবে। এরজন্য যত বেশি অর্থায়ন উৎসের সঙ্গে বাংলাদেশ যোগাযোগ রাখবে, তত বেশি সরকারের বার্গেনিং সক্ষমতা বাড়বে।’

আঞ্চলিক সংযোগ: বাংলাদেশ, ভারতের উত্তর-পূর্বে সাতটি রাজ্য, নেপাল ও ভুটানকে কেন্দ্র করে উপ-আঞ্চলিক সহযোগিতার বিষয়ে আগ্রহ রয়েছে ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের। এরমধ্যে পরিবহন বা সংযোগ (কানেক্টিভিটি) ও নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে আগ্রহী তারা।

এ বিষয়ে সাবেক পররাষ্ট্র সচিব বলেন, ‘উপ-আঞ্চলিক কানেক্টিভিটি বৃদ্ধির জন্য সম্প্রতি আসামে একটি অনুষ্ঠান হয় এবং সেখানে ইইউসহ অন্যান্য সংশ্লিষ্টরা উপস্থিত ছিল। সেখানে ইইউ প্রতিনিধি জানিয়েছে, এ অঞ্চলের কানেক্টিভিটি বৃদ্ধির জন্য তহবিল জোগান দিতে আগ্রহী তারা।’

এর সঙ্গে ইন্দো-প্যাসিফিকের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক আছে জানিয়ে তিনি বলেন, বঙ্গোপসাগরের একদম কেন্দ্রে রয়েছে বাংলাদেশ এবং এ অঞ্চলের অন্য জায়গাগুলো যদি সমুদ্রে প্রবেশাধিকার চায়, তবে বাংলাদেশ একটি আদর্শ স্থান। ফলে উপ-আঞ্চলিক সংযোগের ক্ষেত্রে বাংলাদেশকে প্রয়োজন। এ বিষয়টি নিয়ে যদি অগ্রসর হওয়া যায়, তবে এ অঞ্চলের সবার উপকার হবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published.