দিলেন কপিরাইট স্ট্রাইক, পাঠালেন আদালতের আদেশ!

প্রশান্তি ডেক্স ॥  ‘ও পৃথিবী এবার এসে’ গানটি নিয়ে অভিনব আইনি জালিয়াতি এখন ভোক্তভোগিরা। গত বছর পাঁচেক আগেও দেশের শিল্প-সংস্কৃতির অন্যতম আতংকের নাম ছিলো মেধাস্বত্ব জটিলতা কিংবা কপিরাইট ক্রাইম। বিশেষ করে সংগীতাঙ্গনকে একরকম পংগুই করে দিয়েছিলো এই বিষয়টি। ঘটেছে মামলা ও জেল-জরিমানার ঘটনাও। এমন জটিলতায় পড়ে অসংখ্য জনপ্রিয় বা দরকারি গানের অকাল মৃত্যুও ঘটেছে। তবে সেসব জটিলতা পেরিয়ে দেশের কপিরাইট আইন এখন অনেকটাই কার্যকর। বিদ্যমান কপিরাইট আইনের পাশাপাশি অনলাইন স্ট্রিমিং মাধ্যমগুলোও এ বিষয়ে এখন বেশ কঠোর। ফলে কপিরাইট ইস্যুতে আজকাল আর তেমন কোনও জটিলতার খোঁজ মেলে না।

ঠিক এমন স্বস্তিকর সময়ে দেশের অন্যতম একটি ঐতিহাসিক গানের মালিকানা নিয়ে দেখা দিয়েছে অভিনব কপিরাইট জটিলতা। সেটিকে এক কথায় বিস্ময়কর জালিয়াতিও বলা যায়। এটি হতে পারে কপিরাইট ইস্যুতে নতুন গবেষণার বিষয়ও। সে বিষয়ে বিস্তারিত যাওয়ার আগে জেনে নেওয়া যাক মূল ঘটনাটি।

ক্রিকেটপ্রেমী কিংবা গান-প্রিয়দের নিশ্চয়ই মনে আছে, ২০১১ সালে বাংলাদেশে অনুষ্ঠিত আইসিসি বিশ্বকাপের অফিসিয়াল স্বাগত সংগীত ‘ও পৃথিবী এবার এসে বাংলাকে নাও চিনে’ গানটির কথা। জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারজয়ী গীতিকবি জুলফিকার রাসেলের কথায় এর সুর ও সংগীত পরিচালনা করেছেন ইবরার টিপু। এতে কণ্ঠ দিয়েছেন ইবরার টিপু, অর্ণব, মিলা, বালাম, কণা ও এলিটা। বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়ামে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপস্থিতিতে গানটি পরিবেশিত হয় উদ্বোধনী মঞ্চে। তখন থেকে এখনও গানটি দেশে-বিদেশে ব্যাপক জনপ্রিয়। যথাযথ অনুমতি নিয়ে নিজের ইউটিউব চ্যানেলে গানটি আপলোড করেন এর অন্যতম স্বত্বাধিকারী (রচয়িতা হিসেবে) জুলফিকার রাসেল।

গানটির মূল ভিডিও: https://youtu.be/Z5f5Qy5CVvE                  

https://youtu.be/Z5f5Qy5CVvE?t=42

 উজ্জ্বল সেই ঘটনার ঠিক এক যুগ পর সম্প্রতি কক্সবাজারের জালাল উদ্দিন নামের জনৈক ব্যক্তি ঐতিহাসিক গানটিকে নিজের ইউটিউব চ্যানেলে আপলোড করে কপিরাইট ক্লেইম করেন মূল মালিক জুলফিকার রাসেলকে! যথারীতি সেই কপিরাইট স্ট্রাইক থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য গানটির সকল তথ্য-প্রমাণ ইউটিউব কর্তৃপক্ষকে পাঠিয়ে রেহাই পেতে হলো।  না, এখানেই থামেননি অজ্ঞাতনামা জালাল। বরং তার জালিয়াতি এগিয়েছে আরও অভিনব কায়দায়।

এরপর তিনি কক্সবাজার চকরিয়ার সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের বিচারক মো. জাহিদ হোসাইনের নাম, সিল-স্বাক্ষর সমেত ১৭ অক্টোবর প্রেরিত একটি আদেশপত্রও পাঠিয়েছেন ইউটিউব কর্তৃপক্ষ এবং জুলফিকার রাসেল বরাবর! ফের ইউটিউব কর্তৃপক্ষ মূল চ্যানেলের গানটিকে (জুলফিকার রাসেলের চ্যানেল) ব্লক করে দেয়। রায় যায় জালাল উদ্দিনের পক্ষে। এমন ঘটনায় বিস্মিত ও বিব্রত হয়ে পড়েন গানটির প্রণেতাগণ। কারণ, বিষয়টি আদালত পর্যন্ত গড়ালো।

এমন ঘটনা অনুসন্ধানে বাংলা ট্রিবিউন পত্রিকার অনুসন্ধানি প্রতিবেদকের মাধ্যমে আমাদের প্রতিনিধি খুঁজে পায় জালালের পরিচয়। তিনি কক্সবাজারের পেকুয়া উপজেলার সদর ইউনিয়নের সিকদারপাড়া গ্রামের আজিজুল হকের ছেলে জালাল উদ্দিন এবং এটুকুও নিশ্চিত হওয়া গেলো, আদালতের ওই আদেশ সম্পূর্ণ ভুয়া। অথচ জালাল উদ্দিন ওই আদেশপত্র ইউটিউব কর্তৃপক্ষকে পাঠালে গীতিকবি জুলফিকার রাসেলের চ্যানেল থেকে আবারও গানটি ব্লক হয়ে যায়। পায় স্ট্রাইক নোটিশ। বিষয়টি দেখে ফের বিস্মিত ও বিব্রত হন গানের লেখক জুলফিকার রাসেল। পাশাপাশি এ বিষয়ে নিশ্চিত হওয়ার জন্য কক্সবাজার জেলা ও দায়রা জজ আদালতের আইনজীবীর সঙ্গেও যোগাযোগ করেন তিনি।

৫ অক্টোবর জুলফিকার রাসেল বরাবর জালাল উদ্দিনের পাঠানো মেইল বার্তা আদালতের আইনজীবীর সঙ্গে দেখা করে এ বিষয়ে বিস্তারিত খোঁজখবর নেন । তিনি চকরিয়ার সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের বিচারক, আইনজীবী এবং পেশকারের কাছে এ ব্যাপারে জানতে চাইলে তারা জানান, উল্লেখিত তারিখে এমন ধরনের কোনও আদেশ ইস্যু করেননি আদালত। এমনকি গীতিকবি জুলফিকার রাসেলের নামে আদালতে কোনও অভিযোগ কেউ করেনি। পরে আদেশপত্রের ছবি দেখে, বিচারক, আইনজীবী এবং পেশকার বলেন, ‘এটি ভুয়া আদেশপত্র। বিচারকের সিল-স্বাক্ষর জালিয়াতি করে আদেশপত্রটি তৈরি করা হয়েছে।’

সাংবাদিক আবদুল আজিজ জানান, গীতিকবি জুলফিকার রাসেলের বিরুদ্ধে আদালতের আদেশের (মামলা নং-সি আর-১০৯) কপিটি যাচাই-বাছাই করেন বিচারক। সবশেষে আদালত থেকে জানানো হয়, ওই আদেশপত্র আদালতের নয়, এমন কোনও আদেশ ইস্যু করেননি বিচারক। সেইসঙ্গে সি আর-১০৯ নম্বর মামলার বাদী এবং বিবাদী অন্য কেউ। যেখানে জুলফিকার রাসেল বা জালাল উদ্দিন নামের কেউ নেই। মূলত অন্য একটি মামলা এবং বিচারকের সিল-স্বাক্ষর জালিয়াতি করে গীতিকবি জুলফিকার রাসেলের বিরুদ্ধে ভুয়া আদেশপত্র তৈরি করেছেন প্রতারক জালাল উদ্দিন।

এ ঘটনায় বিস্ময় প্রকাশ করে সাংবাদিক বাংলা ট্রিবিউন-এর সম্পাদক ও গীতিকবি জুলফিকার রাসেল বলেন, ‘দেশে এ ধরনের প্রতারকও রয়েছে, যে অন্যের গান নিজের দাবি করে বিচারকের সিল-স্বাক্ষর জালিয়াতি করার সাহস পায়! আমি বিস্মিত হয়েছি। সে নিজেও ব্যক্তিগতভাবে মেইল করে আমার কাছে স্বীকার করেছে, আদালতের কাগজপত্র জাল। জালাল উদ্দিন দুই ধরনের অপরাধ করেছে। একটি হলো কপিরাইট আইনে, অপরটি জালিয়াতি। এরকম কাজ সে এবং অন্য কেউ যেন আর করার সাহস না করে, তাই বিষয়টি নিয়ে আমি আদালতে মামলার প্রস্তুতি নিচ্ছি।’

জুলফিকার রাসেল এমন জালিয়াতি ফৌজদারি অপরাধ বলে উল্লেখ করেছেন। কক্সবাজার জেলা ও দায়রা জজ আদালতের সিনিয়র আইনজীবী আয়াছুর রহমান বলে এটি ফৌজদারী অপরাধের সামিল। কোনও ব্যক্তি যদি আদালত ও বিচারকের সিল-স্বাক্ষর জালিয়াতি করে এবং সেটি আদালতে প্রমাণিত হয়, তাহলে তিন থেকে সাত বছর পর্যন্ত কারাদন্ড হবে। এ ধরনের ঘটনায় আবার আদালত সপ্রণোদিত হয়েও মামলা করতে পারেন। একইসঙ্গে অভিযুক্ত ব্যক্তির বিরুদ্ধে ব্যবস্থাও নিতে পারেন।’

একই কথা বলেছেন হাইকোর্টের সিনিয়র আইনজীবী ফজলুর রহমান। তিনি বলেন, ‘এটি ফৌজদারি অপরাধ। জালিয়াতি প্রমাণ হলে এর শাস্তি হিসেবে অভিযুক্ত ব্যক্তিকে অর্থদন্ড বা কারাদন্ড কিংবা উভয় দন্ড ভোগ করতে হবে।’

এ বিষয়ে জানতে অভিযুক্ত জালাল উদ্দিনের সঙ্গে আইনজীবীর মাধ্যমে গত কয়েকদিন ধরে যোগাযোগ করা হয়। কিন্তু তাতে সাড়া দেননি তিনি। তার ব্যক্তিগত মোবাইল নম্বরে একাধিকবার কল দিলেও রিসিভ না করায় বক্তব্য পাওয়া যায়নি।

Leave a Reply

Your email address will not be published.