বিশ্ববিদ্যালয়ে যৌন হয়রানি নিরোধ সেল দায়সারা, তথ্যহীনতা আর অসংবেদনশীলতায় আক্রান্ত

প্রশান্তি ডেক্স ॥ হাইকোর্টের নির্দেশনা অনুযায়ী বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যৌন হয়রানি প্রতিরোধ কমিটি গঠন করা হয় না। আবার কোথাও কোথাও নির্দেশনা অনুযায়ী কমিটি হলেও সেটি হয় দায়সারা গোছের। এর পেছনে রাজনৈতিক ক্ষমতার অপব্যবহার আর শিক্ষকদের প্রভাব বিস্তারকে দায়ী করছেন সংশ্লিষ্টরা। এমনকি, অভিযোগ এলেও ইচ্ছাকৃত দেরি করা হয়, যাতে অভিযোগকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের গন্ডি পার হয়ে যায়। তারা মনে করেন, ছাত্রীর বিদায়ের মধ্য দিয়েই যৌন হয়রানির অভিযোগের সমাপ্তি ঘটবে।

গত কয়েক বছরের অভিযোগের ধরন বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, বিশ্ববিদ্যালয়ের নারী শিক্ষার্থী থেকে নারী শিক্ষক কেউই বাদ যাচ্ছেন না এই হয়রানি থেকে। এ তালিকায় বারবার শোনা যায় প্রধান পাঁচটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের কথা। সর্বশেষ জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের ছাত্রী ফাইরুজ অবন্তিকা ফেসবুকে পোস্ট দিয়ে আত্মহত্যা করলে বিষয়টি নতুন করে সামনে আসে।

পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে গঠিত সেলগুলোয় বিভিন্ন সময়ে কাজ করেছেন যারা তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, আইন না থাকা এবং তদন্ত কমিটির দেওয়া সুপারিশ সিন্ডিকেটে ঠিকভাবে উপস্থাপিত না হওয়ার কারণে বেশিরভাগ অভিযোগ নিষ্পত্তি হয় দায়সারাভাবে। তবে যদি অভিযোগকারী বা অভিযুক্ত কেউ পুরো প্রক্রিয়া নিয়মিত ফলোআপ করতে থাকে বা গণমাধ্যম যদি কোনোটির বিষয়ে সতর্ক দৃষ্টি রাখে তবেই গুরুত্ব দিয়ে কাজটি করা হয়। এমনকি অভিযোগকারী কেউ কেউ দাবি করেছেন, কেন অভিযোগ দাখিল করলো সেটি নিয়ে কমিটির পক্ষ থেকে তারা অসংবেদনশীল আচরণ পেয়েছেন এবং তাদের বিশ্ববিদ্যালয় জীবন আরও অসহনীয় হয়ে উঠেছে।

২০০৮ সালের ৭ আগস্ট শিক্ষার্থীদের যৌন হয়রানির ঘটনার বিচার চেয়ে হাইকোর্টে একটি রিট করা হয়। ওই রিটের পরিপ্রেক্ষিতে ২০০৯ সালের ১৪ মে দেশের উচ্চ আদালত যৌন হয়রানি প্রতিরোধে সব সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে লিখিত নির্দেশনা প্রদান করে। পরে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে ১০(ক) ধারায় যৌন হয়রানির সংজ্ঞায় নারীকে অশালীন মন্তব্য, অঙ্গভঙ্গি, সাংকেতিক চিহ্ন প্রদর্শনসহ ইন্টারনেট ও মোবাইলে হয়রানিকেও আওতাভুক্ত করা হয়। হাইকোর্টের নির্দেশনায় যৌন হয়রানির বিচার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে ৬০ কর্মদিবসের মধ্য শেষ করতে বলা হয়েছে, ব্যর্থ হলে প্রচলিত আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়ার কথাও বলা আছে।

কোন বিশ্ববিদ্যালয়ের কী হাল : ২০১০ সালের ১০ মার্চ হাইকোর্টের নির্দেশে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে যৌন নির্যাতন সংক্রান্ত অভিযোগ কমিটি গঠন করা হয়। কমিটি গঠনের পর থেকে এখন পর্যন্ত মোট ৩০টি অভিযোগ পাওয়া গেছে। যার মধ্যে ১৩টি অভিযোগ ২০২২ সালের পর এসেছে এবং তার ১১টি নিষ্পত্তি করা হয়েছে। বাকি দুটি অভিযোগ বা ২০২২ সালের আগের অভিযোগ বিষয়ে সঠিক তথ্য পাওয়া যায়নি।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ২০১০ থেকে এখন পর্যন্ত ৩৪টা অভিযোগ করা হয়েছে যৌন হয়রানি ও নিপীড়ন নিরোধ সেলে। এর মধ্যে যৌন হয়রানি এবং নিপীড়ন নিরোধ সেল ২৮টি অভিযোগের তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিয়েছে বলে সূত্র জানায়।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জনসংযোগ দফতর থেকে পাওয়া তথ্য মতে, যৌন নিপীড়নবিরোধী সেল প্রতিষ্ঠার পর থেকে ১২টি অভিযোগ আসে। এর মধ্যে ১০টি মীমাংসা করা হয়েছে আর বাকি ২টি প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। তবে সেলের বর্তমান পরিচালক অধ্যাপক জিনাত হুদা জানান, তিনি দায়িত্ব পালন করছেন দেড়-দুই বছর ধরে। এই সময়ে ৪টি অভিযোগ এসেছে। নিয়ম না থাকায় কোনও অভিযোগের বিষয়ে সুনির্দিষ্টভাবে তিনি কথা বলতে রাজি হননি।

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে ২০১৮ সাল থেকে তথ্য পাওয়া যায়। সে অনুযায়ী মোট অভিযোগের সংখ্যা ৮টি। তার মধ্যে বর্তমানে সিন্ডিকেটের অপেক্ষায় মানিক মুন্সী আর আবু শাহেদ ইমন রয়েছেন।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের যৌন হয়রানি ও নিপীড়ন নিরোধ কেন্দ্রের অভিযোগ কমিটির আহ্বায়ক ড. জরিন আখতার। তিনি বলেন, আমি ৬ মাস হলো এই কমিটিতে এসেছি। এ সময়ে দুটো অভিযোগ আমাদের কমিটির কাছে তদন্তের জন্য এসেছে। যার মধ্যে একটি ছিল শিক্ষককে শিক্ষকের হয়রানি। সেটি দ্রুততার সঙ্গে নিষ্পত্তি হয়েছে। বাকি একটির কাজ চলছে। তবে এর আগের কোনও অভিযোগ কীভাবে নিষ্পত্তি হয়েছে তা আমার জানা নেই।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক জোবাইদা নাসরীন মনে করেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় যৌন নির্যাতন প্রতিরোধ সেলটি হাইকোর্টের নির্দেশনা অনুযায়ী হয়নি। তিনি বলেন, হাইকোর্টের রায়ে কমিটিতে অধিক নারী ও একজন আইনজ্ঞ থাকার কথা, কিন্তু সেটা মানা হয়নি। বলা বাহুল্য, বেশিরভাগ কমিটি বিশ্ববিদ্যালয় ঊর্ধ্বতনদের পছন্দমতো করা হয়। এক্ষেত্রে তদন্ত প্রভাবিত হবে সেটাই স্বাভাবিক।

এদিকে, আমরাই পারি জোট, ইউএনওমেন ছয়টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যৌন হয়রানি প্রতিরোধ কমিটি তৈরিতে টেকনিক্যাল সাপোর্টের কাজ করে। জোটের সমন্বয়ক জিনাত আরা হক বলেন, আমাদের দেশে একটা বড় প্রতিবন্ধকতা হচ্ছে আইন বা নীতি করা হলেও তা বাস্তবায়ন করার জন্য কোনও দায়বদ্ধতা থাকে না। এই যে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে কমিটি হচ্ছে না বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক কমিটি তা আমলেই আনছে না।

সেলগুলো তদন্ত প্রতিবেদন দেওয়ার পরে সেটি সিন্ডিকেটে তোলার বিষয়ে গড়িমসি আছে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। বেশ কিছু দিন কমিটিতে কাজ করেছেন এমন একজন শিক্ষক বলেন, কমিটিকে সবাই নিজেদের মতো করে রাজনৈতিকভাবে ব্যবহার করতে চায়। অভিযুক্ত ব্যক্তি কমিটিকে যখন প্রভাবিত করতে না পারে তখন রাজনৈতিক পরিচয় ব্যবহার করে সিন্ডিকেটে প্রতিবেদন না তোলার জন্য চেষ্টা করে। সিন্ডিকেটে না তোলার ব্যাপারে করণীয় কী হতে পারে জানতে চাইলে তিনি বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে যৌন হয়রানি ও নিপীড়ন নিরোধ সেল তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিলে কতদিনের মধ্যে সেটা সিন্ডিকেটে উত্থাপিত হবে এরকম কোনও নীতিমালা নেই। ৬০ দিনের মধ্যে তদন্ত শেষ হবে, তারপরে কী হবে? সিন্ডিকেট কতটা কী করতে পারবে সে বিষয়গুলো স্পষ্ট নয়। ফলে কোনটা কতদিনের মধ্যে সিন্ডিকেটে উঠছে সে হিসাবও থাকে না।

Leave a Reply

Your email address will not be published.