ইরান কি ইসরায়েলি হামলা প্রতিহত করতে পারবে?

প্রশান্তি আন্তর্জাতিক ডেক্স ॥ ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু যদি বৈশ্বিক চাপ উপেক্ষা করে ইরানে পাল্টা হামলার সিদ্ধান্ত নেন তাহলে পুরনো আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে ঝুঁকিতে থাকবে তেহরান। এমন পাল্টা হামলায় ইরানের ক্ষয়ক্ষতির পাশাপাশি ইসরায়েলকেও চড়ামূল্য দিতে হবে। বিশ্লেষকরা বলছেন, বড় ধরনের কূটনৈতিক ও কৌশলগত ক্ষতির আশঙ্কা ইসরায়েলকে হয়ত পাল্টা হামলা থেকে বিরত রাখতে পারে। তবে ইরানের অভ্যন্তরে আঘাত করতে ইসরায়েলকে খুব বেশি বেগ পেতে হবে না। কারণ দেশটির বিমানবাহিনী প্রচলিত ঘরানার নয় এবং পুরনো আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা রাশিয়ার সাবেকি মডেলগুলোর ভিত্তিতে তৈরি। ব্রিটিশ বার্তা সংস্থা রয়টার্স এ খবর জানিয়েছে।

গত শনিবারের হামলা ইরানি বিমান হামলার শক্তি ও ইসরায়েলের দুর্ভেদ্য প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার শক্তি প্রদর্শন করেছে। ইরানের ছোড়া কয়েক শ’ ড্রোন, ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র ও ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্রের প্রায় সবগুলো ভূপাতিত করেছে ইসরায়েলি সেনাবাহিনী। দেশটিকে বড় ধরনের ক্ষয়ক্ষতির মুখে পড়তে হয়নি।

ইসরায়েলের সাবেক বিমান প্রতিরক্ষা প্রধান জভিকা হাইমোভিচ বলেছেন, কৌশলগত ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোনের ক্ষেত্রে একটি পরাশক্তি ইরান।

কিন্তু দেশটির আকাশ প্রতিরক্ষায় পিছিয়ে রয়েছে। এই প্রতিরক্ষা গড়ে উঠেছে মূলত রাশিয়ার এস-২০০ ও এস-৩০০ বিমানবিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবস্থা বা স্থানীয়ভাবে তৈরি ব্যবস্থার ওপর ভিত্তি করে। ইরানের তৈরি ব্যবস্থাগুলোর মধ্যে রয়েছে বাভার-৩৭৩, খোরদাদ, রাত, সায়াদ ও তালাশ। দেশটির যুদ্ধবিমানগুলো বেশিরভাগ পুরনো মার্কিন ও রুশ যুদ্ধবিমান। অনেকগুলো ১৯৭০ দশকে শাহ মোহাম্মদ রেজা পাহলভির আমলের।

এমন ধরনের আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাগুলো ২০১৫ সাল থেকে সিরিয়ায় মোতায়েন রয়েছে। এর ফলে এগুলোর বিরুদ্ধে হামলা পরিচালনায় ইসরায়েলি পাইলটদের অনেক বছরের অভিজ্ঞতা রয়েছে।

হাইমোভিচ বলেছেন, ইসরায়েলি ও জোটের বিমানবাহিনী এসব প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা থাকা অঞ্চলে যুদ্ধবিমান উড়িয়েছে। কীভাবে এগুলোকে মোকাবিলা করতে হয় তারা তা জানে। তাদের প্রতি আমার শ্রদ্ধা রয়েছে। কিন্তু ইরানকে মোকাবিলার ক্ষেত্রে এটিই প্রধান চ্যালেঞ্জ নয়।

লন্ডনভিত্তিক রয়্যাল ইউনাইটেড স্ট্র্যাটেজিক ইনস্টিটিউট-এর রিসার্চ ফেলো সিদ্ধার্থ কাউশা বলেছেন, ইরানের ভূমি থেকে আকাশে নিক্ষেপযোগ্য ক্ষেপণাস্ত্রকে এড়ানো হয়ত ইসরায়েলের প্রধান চ্যালেঞ্জ নয়। গুরুত্বপূর্ণ হলো সফলভাবে ইরানের পশ্চিম ও দক্ষিণে সামরিক ঘাঁটিতে আঘাত করা হয়। এমন হামলার জন্য ভেদ করে ভেতরে প্রবেশে সক্ষম বোমার প্রয়োজন হবে।

তিনি বলেছেন, এফ-৩৫ যুদ্ধবিমান রয়েছে ইসরায়েলে। এগুলো ইরানের আকাশ প্রতিরক্ষার নেটওয়ার্ককে ফাঁকি দিতে পারবে। এগুলোতে সাধারণ ছোট আকারের বোমা থাকে। কিন্তু ভূগর্ভের গভীরে থাকা স্থাপনায় আঘাত করতে আরও বড় বোমা প্রয়োজন হয়। ফলে তাদের হয়ত এফ-১৬ এর মতো যুদ্ধবিমান ব্যবহার করা লাগতে পারে। এগুলোর রাডারে ধরা পড়ার আশঙ্কা বেশি। নিরাপত্তার জন্য পাইলটরা হয়ত দূর থেকে বোমাবর্ষণ করবে।

কাউশা বলেছেন, এসব যুদ্ধবিমানকে আটকে দেওয়ার মতো আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা হয়ত ইরানের নেই। কিন্তু এতে ইসরায়েলের ক্ষয়ক্ষতির ঝুঁকি বাড়ে। আর অন্তত তাত্ত্বিকভাবে ধেয়ে আসা বোমা প্রতিহত করার কিছুটা সুযোগ বাড়বে ইরানের।

ইসরায়েল সরাসরি ইরানের হামলার ঝুঁকি নেবে কিনা তা মূলত নির্ভর করছে ইরানি হামলা কতটা কার্যকরভাবে ঠেকাতে পারবে দেশটি, সেই আত্মবিশ্বাসের ওপর। উত্তেজনা আরও বাড়লে ইরান হয়ত আরও শক্তিশালী অস্ত্র বের করতে পারে অস্ত্রাগার থেকে। এগুলোর মধ্যে রয়েছে সাড়ে তিন হাজারের বেশি ক্ষেপণাস্ত্র ও হাজার দেশক ড্রোন রয়েছে।

ইসরায়েলের একাধিক স্তরের আকাশ প্রতিরক্ষা গড়ে তোলা হয়েছে উচ্চ উচ্চতার অ্যারো ব্যবস্থাকে ঘিরে। ইরানি হামলার সময় এই ব্যবস্থা কার্যকর ছিল। রয়েছে মধ্যপাল্লা ডেভিড’ ষ্টিং ও স্বল্পপাল্লার আয়রন ডোম। গাজা ও লেবানন থেকে ছোড়া কয়েক হাজার রকেট ইতোমধ্যে ভূপাতিত করেছে এই ব্যবস্থা।

সফলভাবে হামলা প্রতিহত করতে পারলেও এর পেছনে ব্যয় অনেক। ইসরায়েলি কর্মকর্তারা বিস্তারিত জানাননি. তবে একাধিক বিশ্লেষকের মতে, ইসরায়েলে হামলায় ইরানের ব্যয়ের পরিমাণ ৮০ থেকে ১০০ মিলিয়ন ডলার। বিপরীতে হামলা প্রতিহত করতে ইসরায়েল ও দেশটির মিত্রদের ব্যয় হয়েছে প্রায় ১ বিলিয়ন ডলার।

ইউক্রেন এখন নিজেদের আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার গোলাবারুদ নিশ্চিত করতে পারছে না। এতে দেশটির প্রতিরক্ষায় দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব পড়ছে। ইরান থেকে নিয়মিত হামলার শিকার বা লেবানন থেকে ইরানপন্থি হিজবুল্লাহ গোষ্ঠীর ধারাবাহিক হামলার প্রভাব পড়ছে ইসরায়েলের অস্ত্রাগারে।

গত বুধবার মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন কংগ্রেসের কাছে ইসরায়েলের জন্য সহযোগিতা পাস করার আহ্বান জানিয়েছেন। এই সহযোগিতায় ইসরায়েলের আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার সরঞ্জামের মজুদ বাড়াবে।

ইসরায়েলের আকাশ প্রতিরক্ষা টাস্ক ফোর্সের প্রধান ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ডরোন গাভিশ বলেছেন, ইরান বা ইরানি প্রক্সিদের আরেকটি সম্ভাব্য হামলা মোকাবিলার প্রস্তুতির অংশ হিসেবে মজুদ বাড়াতে দিনরাত পরিশ্রম করা হচ্ছে। আমাদের সরবরাহ প্রয়োজন বলেন অনুভূত হচ্ছে। ইসরায়েলি বিমানবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত জেনারেল আমোস ইয়াডলিন বলেছেন, তিনি মনে করেন হুমকি নিশ্চিহ্ন না করে প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ঠেকাবে-এমন অবস্থান নিয়ে বসে থাকবে না ইসরায়েল। হামলা কীভাবে করতে হয় তা শুধু ইরান জানে না, ইসরায়েলেরও হামলার অনেক বিকল্প আছে। ইসরায়েল শুধু ইরানের হামলা ঠেকিয়ে যাবে, এমন কোনও পরিস্থিতি হবে না।

Leave a Reply

Your email address will not be published.