মহান মে দিবসের তপ্ত রোদেও থামেনা তাদের কাজ

প্রশান্তি ডেক্স ॥ ঢাকার রাস্তায় রিকশা চালান নীলফামারীর জয়নাল। ১০ বছর ধরে এই পেশায় আছেন তিনি। শীত, গ্রীষ্ম বা বৃষ্টি কিছুই তাকে দমাতে পারে না। রাস্তায় থাকতে থাকতে শরীরের অনুভূতি কমে গেছে। এবারের এই তীব্র গরমে কেমন আছেন এ প্রশ্নের জবাবে জয়নাল বলেন, অনেক কষ্ট হচ্ছে। এমন কষ্ট আগে কোনও দিন হয়নি। দুপুরের দিকে মুখটা মনে হয় পুড়ে যায়! শুধু জয়নাল নয়, অস্বস্তিকর গরমে নাকাল শহরের সব শ্রমিক।

মে দিবসে রিকশা চালাবেন? এ প্রশ্নে জয়নাল বলেন, তিনি জানেন এমন একটা দিন আছে। কিন্তু সেই দিন কেন হয়, কী হয় এসবের কিছুই জানেন না। সহজ মুখে সোজা উত্তর দিলেন, আমাগো আর মে দিবস কীয়ের!

জয়নালের মতো শ্রমিকদের নেই কোনও বিশ্রামের সুযোগ, না আছে আয়ের নিশ্চয়তা, না আছে শ্রমঘণ্টা। রোদবৃষ্টি ঝড়ে কাজ করে চলাই যেন রিকশাচালক, হকার, নির্মাণশ্রমিক, ইটভাটার শ্রমিক, কৃষকসহ শ্রমজীবীদের নিয়তি। তাপমাত্রার ওঠানামায় তাদের কিছু যায় আসে না। কাজ না করলে ঘরে আসে না চাল, পেটে জোটে না ভাত। ফলে তীব্র গরমেও থেমে নেই তাদের কাজ। এমনই এক পরিস্থিতিতে দেশে পালিত হয়েছে মহান মে দিবস।

গত বুধবার ১ মে ছিল মহান মে দিবস। ১৮৮৬ সালের এই দিনে যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো শহরের হে মার্কেটের শ্রমিকেরা শ্রমের উপযুক্ত মূল্য ও দৈনিক অনধিক আট ঘণ্টা কাজের দাবিতে আন্দোলনে নামেন। ওই দিন আন্দোলনরত শ্রমিকদের ওপর পুলিশ গুলি চালায়। এতে অনেক শ্রমিক হতাহত হন। তাদের আত্মত্যাগের মধ্য দিয়ে দৈনিক কাজের সময় আট ঘণ্টা করার দাবি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। এরপর থেকে দিনটি মে দিবস হিসেবে পালিত হয়ে আসছে। দিবসটির এবারের নির্ধারিত প্রতিপাদ্য-‘শ্রমিক মালিক গড়বো দেশ, স্মার্ট হবে বাংলাদেশ।’

চলমান তাপদাহে রাজধানীর বসুন্ধরা শপিং মলের সামনের ফুটপাথ ফাঁকা পড়ে আছে। অথচ এখানে প্রতিদিন ক্রেতা-বিক্রেতার জন্য হাঁটাই কষ্টকর হয়ে দাঁড়াতো। এখন দোকান খুললেও ক্রেতা পাচ্ছেন না হকাররা। এদের একজন আব্দুর রহমান। তিনি জানালেন, গরম পড়ার পর মানুষ আর তেমন আসছে না। এজন্য বেশি সময় দাঁড়িয়ে থাকতে হচ্ছে। পিচের রাস্তার তাপে মুখ পুড়ে যাচ্ছে।

ঢাকায় গত মঙ্গলবার সর্বোচ্চ তাপমাত্রা উঠেছে ৩৮ দশমিক ৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস, যা সোমবার ছিল ৪০ দশমিক ৩ ডিগ্রি, রবিবার ৩৯ ডিগ্রি, এর আগের দিন শনিবার ছিল ৩৭ দশমিক ৪ ডিগ্রি। বাতাসে জ্বলীয়বাষ্পের আধিক্যের কারণে অস্বস্তিকর গরম অনুভূত হচ্ছে। কাজের জন্য বের হওয়া মানুষ ঘেমে নেয়ে একাকার হয়ে যাচ্ছেন।

রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর বাণী : মহান মে দিবস উপলক্ষে রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পৃথক বাণী দিয়েছেন।

রাষ্ট্রপতি বলেন, বিশ্বব্যাপী আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে শ্রমজীবী মানুষের কঠোর পরিশ্রম, ত্যাগ ও ভূমিকা অনস্বীকার্য। তাই দেশের উন্নয়ন নিশ্চিত করতে হলে শ্রমিকের অধিকার ও উন্নয়ন নিশ্চিত করতে হবে। …শিল্প ও শ্রমবান্ধব বর্তমান সরকার শ্রমিকের সার্বিক কল্যাণ সাধন ও দক্ষতা বৃদ্ধিতে নিরন্তর কাজ করে যাচ্ছে। ২০৪১ সালের মধ্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঘোষিত উন্নত-সমৃদ্ধ ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’ বিনির্মাণে শ্রমিকের পেশাগত নিরাপত্তা ও সুস্থতা, শ্রমিক-মালিক সুসম্পর্ক, উন্নত কর্মপরিবেশসহ শ্রমিকের সার্বিক অধিকার নিশ্চিতকরণের কোনও বিকল্প নেই। মহান মে দিবসে এবারের প্রতিপাদ্য ‘শ্রমিক মালিক গড়বো দেশ, স্মার্ট হবে বাংলাদেশ’ যথাযথ ও সময়োপযোগী হয়েছে বলে আমি মনে করি।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মহান মে দিবস উপলক্ষে বাংলাদেশসহ বিশ্বের সব মেহনতি মানুষকে আন্তরিক শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন জানিয়েছেন। ১৮৮৬ সালের ১ মে যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো শহরে রক্তাক্ত আন্দোলনে শ্রমিকের ন্যায্য দাবি আদায়ের লক্ষ্যে আত্মাহুতি দেওয়া বীর শ্রমিকদের প্রতিও প্রধানমন্ত্রী শ্রদ্ধা নিবেদন করেন।

আওয়ামী লীগ সরকার জাতির পিতার পদাঙ্ক অনুসরণ করে দেশের শ্রমজীবী মানুষের জীবনমান উন্নয়ন ও কল্যাণে বিভিন্ন কার্যক্রম বাস্তবায়ন করে যাচ্ছে উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, ‘মালিক-শ্রমিকের মধ্যে সৌহার্দ্য ও সুসম্পর্ক বজায় রাখার মাধ্যমে নিরাপদ কর্মপরিবেশ, সামাজিক নিরাপত্তা ও শ্রমিক কল্যাণ নিশ্চিত করতে বাংলাদেশ শ্রম আইন যুগোপযোগী ও আধুনিকায়ন করে ‘বাংলাদেশ শ্রম (সংশোধন) আইন-২০১৮’ প্রণয়ন করা হয়েছে। দেশের বিভিন্ন খাতে কর্মরত শ্রমিকদের কল্যাণ নিশ্চিত করতে বাংলাদেশ শ্রমিক কল্যাণ ফাউন্ডেশন গঠন করা হয়েছে। এই তহবিল থেকে যে কোনও শ্রমিক কর্মরত অবস্থায় দুর্ঘটনাজনিত কারণে স্থায়ীভাবে অক্ষম হলে অথবা মৃত্যুবরণ করলে, জরুরি চিকিৎসা ব্যয় নির্বাহ ও দুরারোগ্য ব্যাধির চিকিৎসার জন্য এবং শ্রমিকদের সন্তানের উচ্চশিক্ষার জন্যেও আর্থিক সহায়তা পাচ্ছেন।’

তিনি বলেন, ‘‘আমরা রফতানিমুখী গার্মেন্টস শিল্পে কর্মরত শ্রমিকদের সার্বিক কল্যাণে আর্থিক সহায়তা প্রদানে একটি কেন্দ্রীয় তহবিল গঠন করেছি এবং সহযোগিতা অব্যাহত রেখেছি। এ শিল্পের কর্মহীন এবং দুস্থ শ্রমিকদের সর্বোচ্চ তিন মাসের নগদ আর্থিক সহায়তা প্রদান করে চলমান সামাজিক সুরক্ষা কার্যক্রম সম্প্রসারণ করা হয়েছে। সব সেক্টরে শ্রমিকদের বেতন-ভাতা বাড়ানো হয়েছে। শ্রমিকদের সামাজিক মর্যাদা, স্বাস্থ্য ও সেইফটি নিশ্চিতকল্পে ‘জাতীয় শ্রমনীতি-২০১২’, ‘জাতীয় শিশুশ্রম নিরসন নীতি-২০১০’, ‘জাতীয় পেশাগত স্বাস্থ্য ও সেইফটি নীতিমালা-২০১৩’, ‘বাংলাদেশ শ্রম  বিধিমালা-২০১৫’ এবং ‘গৃহকর্মী সুরক্ষা ও কল্যাণ নীতি-২০১৫’ প্রণয়ন করা হয়েছে।’’

তিনি বলেন, ‘আমাদের সরকারের আন্তরিক প্রচেষ্টার ফলে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক এবং কার্যক্রম আরো সুদৃঢ় হয়েছে। শিল্প-কারখানায় কমপ্লায়েন্স নিশ্চিত করতে কল-কারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন পরিদফতরকে অধিদফতরে উন্নীত করা হয়েছে। শ্রমিক ও তাদের পরিবারের কল্যাণে বিভিন্ন সেবার সম্প্রসারণ ও জোরদারকরণে আমরা শ্রম পরিদফতরকে সম্প্রতি অধিদফতরে রূপান্তরিত করেছি। শ্রমিক ভাই-বোনদের যেকোনও সমস্যা সংক্রান্ত অভিযোগ গ্রহণ, অভিযোগ নিষ্পত্তি ও প্রয়োজনীয় পরামর্শ প্রদানের জন্য সার্বক্ষণিক টোল ফ্রি হেল্প লাইন (১৬৩৫৭) চালু করা হয়েছে। শিল্প কারখানায় বিশেষ করে গার্মেন্টস শিল্পে নিরাপত্তা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে যথাযথ পরিদর্শন ও মনিটরিং ব্যবস্থা চলমান রয়েছে।’

প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমি বিশ্বাস করি, মহান মে দিবসের আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে শ্রমিক-মালিক পরস্পর সুসম্পর্ক বজায় রেখে জাতীয় উৎপাদন বৃদ্ধিতে নিবেদিত হবেন। মে দিবসের চেতনায় দেশের শ্রমিক-মালিক ঐক্য জোরদার করে শ্রমজীবী মানুষের কল্যাণ ও দেশের সার্বিক উন্নয়নের মধ্য দিয়ে জাতির পিতার স্বপ্নের সোনার বাংলাদেশ তথা উন্নত-সমৃদ্ধ স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ে তুলবো; এটাই হোক আমাদের মে দিবসের অঙ্গীকার।’

কর্মসূচি : দিবসটি উপলক্ষে বিভিন্ন শ্রমিক সংগঠনের পক্ষ থেকে  বিস্তারিত কর্মসূচি পালন করা হয়েছে। কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে শ্রমিক সমাবেশ, শোভাযাত্রা, আলোচনা সভা, সেমিনার ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। গত বুধবার সকাল ১১টায় বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় এক আলোচনা সভার আয়োজন করেছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থেকে বক্তব্য রাখেন। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করবেন শ্রম ও কর্মসস্থান মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী মো. নজরুল ইসলাম  চৌধুরী। এছাড়া অনুষ্ঠানে শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন বাংলাদেশ শ্রমিক কল্যাণ ফাউন্ডেশন ও  কেন্দ্রীয় তহবিল হতে দুস্থ শ্রমিকদের আর্থিক সহায়তার  চেক দেওয়া হয়েছে।

বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমিতে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। এছাড়াও শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন দফতর বা সংস্থার মাঠ পর্যায়ের কার্যালয়গুলো জেলা প্রশাসনের সঙ্গে সমন্বয় করে এ দিবসটি পালন করেছে। বিভিন্ন সড়ক দ্বীপ ব্যানার, ফেস্টুন ও প্ল্যাকার্ড দিয়ে সাজানো হয়েছে।

গত বুধবার বিকাল ৩টায় বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয় প্রাঙ্গণে জাতীয় শ্রমিক লীগের উদ্যোগে এক শ্রমিক জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। জনসভায় প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের।

Leave a Reply

Your email address will not be published.