‘সিঁধেল চোর’ ধরতে রাজধানী জুড়ে সাঁড়াশি অভিযানে মরিয়া পুলিশ

প্রশান্তি ডেক্স ॥ রাজধানীতে হঠাৎ করেই বেড়ে গেছে সিঁধেল চুরি। বাসা ফাঁকা পেয়ে দরজা ভেঙ্গে বা গ্রিল কেটে নগদ টাকা বা মূল্যবান সামগ্রী নিয়ে যাচ্ছে চোরেরা। ঈদুল ফিতরের ছুটির কয়েক দিনেই রাজধানী ঢাকায় এরকম ২৮টি চুরির ঘটনা ঘটেছে। আর এপ্রিলে প্রায় অর্ধশত চুরির অভিযোগ পেয়েছে পুলিশ। শুধু ঢাকায়ই নয় বরং সাড়া দেশেই এমন চুরির অভিনব কাহিনী প্রকাশিত হয়েছে। থানায় মামলাও হয়েছে এমনকি ভিডিও ফুটেজও রয়েছে।

ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) কমিশনার সর্বশেষ অপরাধ পর্যালোচনা সভায় সিঁধেল চুরি বন্ধে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে কড়া নির্দেশনা দেন। এরপরই চোর ধরতে মরিয়া হয়ে অভিযান শুরু করেছে পুলিশ। ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের প্রায় প্রতিটি টিম চোর ধরতে মাঠে নেমেছে। গত দুই দিনে চোর চক্রের অন্তত অর্ধশত সদস্যকে গ্রেফতার করা হয়েছে। সংশ্লিষ্ট সূত্রে এই তথ্য জানা গেছে।

ডিএমপির সূত্র জানায়, রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় সিঁধেল চুরি নৈমিত্তিক ঘটনা। বারবার নানা উদ্যোগ নেওয়া হলেও বন্ধ করা যায়নি চুরি। সর্বশেষ ঈদুল ফিতরের তিন দিন আগে, অর্থাৎ ৮ থেকে ১৯ এপ্রিল পর্যন্ত রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় ২৮টি চুরির ঘটনা ঘটে। চুরির ঘটনাগুলো পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, ঈদের ছুটির কারণে পরিবারগুলোর অনেকেই ঢাকার বাইরে ছিলেন। এই সুযোগে চোর চক্রের সদস্যরা কারও বাসার দরজা ভেঙ্গে বা কারও জানালার গ্রিল কেটে বাসায় ঢুকে নগদ টাকা ও মূল্যবান সামগ্রী নিয়ে গেছে। বিষয়টি নিয়ে গত রবিবার (২৮ এপ্রিল) অনুষ্ঠিত মাসিক অপরাধ পর্যালোচনা সভায় ক্ষোভ প্রকাশ করেন ঢাকার কমিশনার হাবিবুর রহমান। তিনি যেকোনও মূল্যে সিঁধেল চোরদের ধরার নির্দেশনা দেন।

ডিএমপি সূত্র জানায়, গত ৮, ৯ ও ১৮ এপ্রিল পল্লবী থানায় এলাকায় তিনটি চুরির ঘটনা ঘটে। একটি ঘটনায় দরজার তালা ভেঙ্গে বাসা থেকে ৩৩ ভরি স্বর্ণালঙ্কার, দুটি মোবাইল, একটি ল্যাপটপ, ৭৮০ ইউরো, ৬০ ডলার ও নগদ ১ লাখ ৭০ হাজার টাকা নিয়ে যায় চোর চক্রের সদস্যরা। আরেক ঘটনায় অজ্ঞাত গৃহকর্মী এক বাসা থেকে ৬ ভরি স্বর্ণালঙ্কার ও নগদ ৫ লাখ টাকা নিয়ে যায়। এছাড়া ১৮ এপ্রিল অপর ঘটনায় দরজা খুলে একটি টিভি, একটি মোবাইল ও নগদ ৬৩ হাজার টাকা নিয়ে যায় চোররা।

গত ৮ ও ১৮ এপ্রিল ওয়ারী থানা এলাকায় ঘটে দুটি চুরির ঘটনা। ৮ এপ্রিল ওয়ারীর একটি বাসার গ্রিল কেটে ৩৩ ভরি স্বর্ণালঙ্কার ও ৩০০ ইউএস ডলার নিয়ে যায় চোর চক্রের সদস্যরা। ১৮ এপ্রিল আরেক বাসার জানালার গ্রিল কেটে ৩৫ লাখ টাকার মালামাল নিয়ে যায়। ৮ এপ্রিল তেজগাঁও থানা এলাকার একটি বাসার দরজার তালা ভেঙ্গে ৯ ভরি স্বর্ণালঙ্কার  ও নগদ দুই লাখ টাকা নিয়ে যায় চোর দল। ১০ এপ্রিল খিলগাঁও থানা এলাকার একটি বাসা থেকে গৃহকর্মী ১০ ভরি স্বর্ণালঙ্কার, পাঁচ ভরি ওজনের একটি রুপার চেইন ও নগদ ২ লাখ ৫০ হাজার টাকা নিয়ে যায়।

১২ এপ্রিল ধানমন্ডি থানা এলাকার একটি বাসার গ্রিল কেটে ২৫ ভরি স্বর্ণালঙ্কার, ৩ লাখ টাকা মূল্যমানের ডায়মন্ডের অলঙ্কার ও নগদ সাড়ে সাত লাখ টাকা চুরি হয়। ১৯ এপ্রিল একই এলাকায় আরেক বাসার গ্রিল কেটে ৪৩ ভরি স্বর্ণালঙ্কার ও নগদ ৩৭ লাখ টাকা নিয়ে যায় চোর চক্রের সদস্যরা। ১৩ এপ্রিল গেন্ডারিয়ার একটি বাসার চালের টিন খুলে একটি ফ্যান, একটি কুলার মেশিনসহ মূলব্যান সামগ্রী নিয়ে যায় চোর।

গত ১৯শে এপ্রিল শুক্রবার ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কসবায় জোহরের নামাজের সময় দোকানের তালা ভেঙ্গে ক্যাশ থেকে টাকা নিয়ে পালিয়ে যায় চোরদ্বয়। এই চুরির সময় ১ মিনিট এবং ঐ দোকানের সিসিটিভি ফুটেজে অভিনব কায়দায় চুরির ঘটনাটি প্রত্যক্ষ্য করা যায় এবং ঐ ঘটনায় ভিডিও ফুটেজসহ থানায় মামলা করা হয়েছে।

সূত্র জানায়, ১৬ এপ্রিল গেন্ডারিয়ার আরেকটি বাসার গ্রিল কেটে ২৫ ভরি স্বর্ণালঙ্কার ও নগদ দেড় লাখ টাকা নিয়ে যায় চোরে। ১৮ এপ্রিল গেন্ডারিয়ার আরেক বাসার গ্রিল কেটে ১৬ ভরি স্বর্ণালঙ্কার ও নগদ ৮২ হাজার টাকা নিয়ে যায় চোর চক্রের সদস্যরা। ১৮ এপ্রিল হাজারীবাগের একটি বাসার দরজার তালা ভেঙ্গে নগদ ৪ লাখ ২০ হাজার টাকা, স্বর্ণের সীতা হার একটি, দুটি স্বর্ণের বড় হার, স্বর্ণের চুরি দুটি, দুই জোরা স্বর্ণের কানের দুল, ২৭টি স্বর্ণের আংটি, ১২টি স্বর্ণের বেবি আংটিসহ মোট ২৮ লাখ টাকা মূল্যমানের মালামাল নিয়ে যায়। ১৫ এপ্রিল দক্ষিণখানা থানা এলাকার একটি বাসার গ্রিল কেটে ২৬ লাখ ৬৭ হাজার টাকার মালামাল নিয়ে যায়।

১৮ এপ্রিল একই থানায় এলাকায় আরেকটি চুরির ঘটনায় একটি বাসার গ্রিল কেটে একটি ল্যাপটপ, একটি আইফোন, এক ভরি ৬ আনা স্বর্ণালঙ্কার ও নগদ ৪ হাজার টাকা নিয়ে যায় চোর। ১৬ এপ্রিল চোর চক্র হাতিরঝিল এলাকার একটি বাসার গ্রিল কেটে একটি ল্যাপটপ, দুইটি ঘড়ি, নগদ ২০ হাজার টাকাসহ ১ লাখ ৩৫ হাজার টাকা মূল্যমানের পোশাক নিয়ে যায়। একই দিনে পল্টন এলাকার একটি বাসার দরজা ভেঙ্গে একটি পানির পাম্প, একটি বাইসাইকেলসহ শার্ট-প্যান্ট ও লুঙ্গিও নিয়ে যায় চোর।

ডিএমপি সূত্র জানায়, গত ১৬ ও ১৭ এপ্রিল সবুজবাগ থানা এলাকার দুটি বাসায় চুরির ঘটনা ঘটে। একটি বাসার গ্রিল কেটে ৪৫ ভরি স্বর্ণালঙ্কার ও নগদ ৭৬ হাজার টাকা এবং আরেকটি বাসার জানালার থাই গ্লাস ও গ্রিল ভেঙ্গে সাড়ে ৭ ভরি স্বর্ণালঙ্কার ও নগদ ৩ লাখ টাকা নিয়ে যায় চোর দল। ১৬ এপ্রিল লালবাগ থানার একটি বাসার গ্রিল কেটে ৭ লাখ ২০ হাজার টাকা ও দুই ভরি ১০ আনা ওজনের স্বর্ণালঙ্কার নিয়ে যায় চোর চোক্রের সদস্যরা।

১৭ এপ্রিল রামপুরা এলাকার একটি বাসার গ্রিল কেটে একটি ল্যাপটপ, একটি ডেস্কটপ কম্পিউটার ও একটি টিভি চুরি হয়। একই দিনে উত্তরখান থানা এলাকার একটি বাসার দরজার তালা ভেঙ্গে সাড়ে ১৪ ভরি স্বর্ণালঙ্কার নিয়ে যায় চোর চক্রের সদস্যরা। এদিন ডেমরা এলাকার একটি বাসার গ্রিল কেটে নগদ ৯ লাখ টাকা, ৫ ভরি স্বর্ণালঙ্কার, একটি মোবাইল, একটি ট্যাবসহ মূল্যবান দলিলপত্রও নিয়ে যায় চোর চক্রের সদস্যরা। ১৮ এপ্রিল একই এলাকার আরেকটি বাসার জানালার গ্রিল কেটে চোর ৫ ভরি স্বর্ণালঙ্কার, নগদ ১১ লাখ টাকা নিয়ে যায়। একইদিন মতিঝিল এলাকার একটি বাসার ঘরের তালা ভেঙ্গে নগদ আড়াই লাখা টাকা ও তিনটি মোবাইল এবং আরেকটি বাসা থেকে একই কায়দায় ২ লাখ ৪৯ হাজার টাকার মালামালা নিয়ে যায়। ১৯ এপ্রিল উত্তরা পশ্চিম থানা এলাকার একটি বাসা থেকে ১ লাখ ৭০ হাজার টাকা মূল্যমানের মালামাল চুরি হয়।

ডিএমপি সূত্র জানায়, এপ্রিলের শুরু থেকে ২১ তারিখ পর্যন্ত রাজধানীতে মোট ৪৯টি সিঁধেল চুরির ঘটনায় মামলা হয়েছে। এসব মামলার আসামিদের গ্রেফতার ও মালামাল উদ্ধারের জন্য সংশ্লিষ্ট থানা পুলিশ ও গোয়েন্দা পুলিশকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। গত ২৩ এপ্রিল যুগ্ম কমিশনার (ক্রাইম) লিটন কুমার সাহা মামলাগুলোর তদন্ত কর্মকর্তা ও সংশ্লিষ্ট জোনের গোয়েন্দা পুলিশের এডিসি ও এসিদের নিয়ে বৈঠক করেন। সর্বশেষ মাসিক অপরাধ পর্যালোচনা পুলিশ কমিশনার হাবিবুর রহমানের কড়া নির্দেশনা দেওয়ার পর চোর চক্রের সদস্যদের ধরতে সাঁড়াশি অভিযান শুরু করেছে পুলিশ।

ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের রমনা বিভাগের অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার আজহারুল ইসলাম মুকুল জানান, সিঁধেল চোরদের ধরতে থানা পুলিশের পাশাপাশি গোয়েন্দা পুলিশের নিয়মিত অভিযান চলছে। চুরির ঘটনায় দায়ের করা মামলার আসামিদের গ্রেফতার ও চুরি হওয়া মালামাল উদ্ধারের চেষ্টা চলছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published.