প্রশাান্তি ডেক্স॥ নিত্যপণ্যের অস্বাভাবিক দাম বাড়ার পেছনে অন্যতম কারণ ছিল সড়ক-মহাসড়কে চাঁদাবাজি। চাঁদাবাজদের দৌরাত্ব্য ছিল দেশের অন্যতম ভোগ্যপণ্যের বাজার চাকতাই-খাতুনগঞ্জে। তবে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর সড়কে চাঁদাবাজি বন্ধ হয়ে গেছে। এতে করে খাতুনগঞ্জে দাম কমেছে নিত্যপণ্যের।
বিশেষ করে গত কয়েকদিন ধরে স্থিতিশীল আছে ভোগ্যপণ্যের দাম। আগে যেখানে নানা অজুহাতে প্রতি ঘণ্টায় দাম ওঠানামা করতো, সেখানে গত রবিবার থেকে বৃহস্পতিবার পর্যন্ত বাজারে সব পণ্যের দাম রয়েছে স্থিতিশীল। নতুন করে দাম বাড়েনি কোনও পণ্যের। তবে বেচাকেনা কিছুটা কমেছে বলে জানালেন ব্যবসায়ীরা। প্রশাসনের মনিটরিং টিমের পাশাপাশি নিয়মিত বাজারের খোঁজখবর নিচ্ছেন শিক্ষার্থীরাও।
ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, নিত্যপণ্য বিভিন্ন স্থান থেকে খাতুনগঞ্জের বাজারে আসতে বেশ কয়েকবার চাঁদা দিতে হতো। এসব চাঁদা নিতো আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কিছু সদস্য ও সরকারদলীয় নেতাকর্মীরা। এখন কেউ না থাকায় হচ্ছে না চাঁদাবাজি। গা-ঢাকা দিয়েছে চাঁদা আদায়ে জড়িতরা। এর প্রভাব পড়েছে বাজারে। গত কয়েকদিন নিত্যপণ্যের দাম স্থিতিশীল আছে। তবে দাম কমার প্রত্যাশা করছেন ক্রেতারা।
খাতুনগঞ্জ হামিদুল্লাহ মিয়া মার্কেট ব্যবসায়ী কল্যাণ সমিতির সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ ইদ্রিস বলেন, ‘সরকারের পতনের পর থেকে সড়কে যানবাহনে কোনও প্রকার চাঁদাবাজি হচ্ছে না। যারা চাঁদাবাজি করতো তারা গা-ঢাকা দিয়েছে। বাজারে এর প্রভাব পড়েছে। কারণ ব্যবসায়ীরা ব্যয় হিসাব করে পণ্য বিক্রি করে থাকেন। তবে চলতি সপ্তাহে নিত্যপণ্যের বাজার স্থিতিশীল আছে। কোনও পণ্যের দাম বাড়েনি। উল্টো কমেছে বেশিরভাগ পণ্যের দাম। তবে ডিও বাণিজ্য বন্ধ হলে পণ্যের দাম আরও কমে আসবে।’
এই ব্যবসায়ী নেতা আরও বলেন, ‘বর্তমানে খাতুনগঞ্জে ভারতীয় পেঁয়াজের কেজি ৯৫-৯৭ টাকা, পাকিস্থানি পেঁয়াজ ৭৫-৮০ টাকা, চায়না পেঁয়াজ ৬০ টাকা করে বিক্রি হচ্ছে। চায়না রসুন ১৭৫ টাকা, আলু ৪৫ টাকা, আদা ২১০ টাকা কেজি বিক্রি করা হচ্ছে। এসব পণ্যের দাম আগের সপ্তাহে ১০ টাকা করে বেশি ছিল।’
গত বৃহস্পতিবার (১৫ আগস্ট) বিকালে চট্টগ্রামের কাঁচা বাজার ঘুরে দেখা গেছে, শাকসবজি, আলু, ডিম, মুরগি, মাছ ও পেঁয়াজের দাম কমেছে। তবে চাল-ডাল ও তেলের দাম আগের জায়গায় স্থিতিশীল আছে। চিচিঙ্গা, ধুন্দল, ঝিঙা, বেগুন, পটল, পেঁপে, ঢ্যাঁড়শ ৪০-৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। তবে বরবটি ও করলা ৭০-৮০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। ১০ দিন আগেও এসব সবজির দাম ছিল ৮০-১০০ টাকা। অর্থাৎ কয়েকদিনের ব্যবধানে দাম কমেছে।
ক্রেতা ও ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, সরকার পতনের আগের দিন প্রতি ডজন ফার্মের মুরগির ডিমের দাম ১৮০ টাকা পর্যন্ত উঠেছিল। যা এখন ১৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। তবে পাড়া-মহল্লার দোকানে এখনও ১৬০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। একইভাবে কমেছে ব্রয়লার মুরগির দাম। প্রতি কেজিতে ২০ টাকা কমে বিক্রি হচ্ছে ১৫০ টাকায়। আন্দোলনের সময় দেশি পেয়াজের কেজি ১২০ টাকায় বিক্রি হয়েছিল, যা এখন ৯৫ টাকায় নেমেছে। একইভাবে আলুর দাম আবারও ৮০ টাকায় উঠেছিল। এখন বিক্রি হচ্ছে ৪৫ টাকায়।
গত রবিবার থেকে বৃহস্পতিবার পর্যন্ত বাজারে সব পণ্যের দাম রয়েছে স্থিতিশীল। চাকতাই-খাতুনগঞ্জ আড়তদার ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক মো. রফিক বলেন, ‘গত সপ্তাহে পণ্যের দাম স্থিতিশীল আছে। কমবেশি বেশিরভাগ পণ্যের দাম কমেছে। তবে বাজারে ক্রেতা কম। সড়কে পণ্যবাহী পরিবহন থেকে আগে চাঁদাবাজি হতো। এখন বন্ধ আছে। এতে গাড়ি প্রতি কিছু টাকা সাশ্রয় হচ্ছে। দাম কমার এটি প্রধান কারণ। তবে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে ওজন নিয়ন্ত্রণের জন্য আছে স্কেল। এটা দেশের আর কোনও মহাসড়কে নেই। স্কেল বসানোর কারণে ব্যবসায়ীরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। প্রতি ট্রাকে ১৮-২০ মেট্রিক টন পণ্য আনা-নেওয়া গেলেও ১৩ টনের বেশি নেওয়া যাচ্ছে না। এতে ভাড়া বেশি পড়ছে। দামেও প্রভাব পড়ছে। তাই ওজন স্কেল সরালে একই খরচে বেশি পণ্য আনা যাবে, দামও আরও কমবে।’
কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) কেন্দ্রীয় কমিটির ভাইস প্রেসিডেন্ট এস এম নাজের হোসাইন বলেন, ‘দীর্ঘদিন ধরে ক্রেতা-বিক্রেতার মাঝখানে কমিশন এজেন্টস নামে একটি মধ্যস্বত্বভোগী নিত্যপণ্যের বাজারে প্রবেশ করে লাভের একটি বড় অংশ হাতিয়ে নিচ্ছে। সরকার পতনের পর কেউ কেউ গা ঢাকা দিয়েছে। আরও কিছু সক্রিয় আছে। আগে আমদানিকৃত পেয়াঁজ নিয়ে চক্রটি সক্রিয় থাকলেও বর্তমানে আলু, মসলা ও সবজিসহ নিত্যপণ্যের অনেকগুলো জায়গায় কোনও প্রকার বিনিয়োগ ছাড়াই বিপুল অংকের অর্থ হাতিয়ে নিচ্ছে। এই কমিশন এজন্টেস ও স্লিপ প্রথা চলমান থাকায় বাজারে জিনিসপত্রের দাম কমছে না। সরকারের আইন প্রয়োগকারী সংস্থা বাজার তদারকিতে গেলেই একে অপরের ওপর দোষ চাপিয়ে দেয়। আর ক্রয়-বিক্রয় রশিদ ছাড়াই শুধুমাত্র একটি চালানের মাধ্যমে কোটি কোটি টাকার ব্যবসা করে যাচ্ছে তারা। নিত্যপণ্যের দাম বাড়ার অন্যতম কারণ কমিশন এজন্টেস ও স্লিপ প্রথা বাণিজ্য। এটি বন্ধ করা গেলে বাজারে সব ধরনের পণ্যের দাম কমে যাবে।’
চট্টগ্রাম মোটরযান শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক মো. আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘বেনাপোল, যশোর কিংবা ঢাকা থেকে এক ট্রাক পণ্য নিয়ে চট্টগ্রামে এলে একাধিক স্থানে চাঁদা দিতে হতো। এর মধ্যে ছিল পৌরসভার নামে টোল, সরকারদলীয় রাজনৈতিক দলের নামে চাঁদা এবং পুলিশের নামেও চাঁদা আদায় করা হতো। প্রতি গাড়ি থেকে অন্তত চার হাজার টাকা নিতো তারা। সরকার পতনের পর থেকে চাঁদাবাজি বন্ধ আছে। চাঁদা আদায়ে জড়িতরা পালিয়ে গেছে। এই চাঁদাবাজি যেন আজীবন বন্ধ থাকে, সে উদ্যোগ সরকারকে নিতে হবে। তাহলে জিনিসপত্রের দাম বাড়বে না।’