প্রশান্তি ডেক্স ॥ চলতি বছরের ডিসেম্বরের মধ্যে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন আদায়ে জনমত সৃষ্টির লক্ষ্যে বেশ কয়েকটি উদ্যোগ নিচ্ছে বিএনপি। এরমধ্যে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে মতবিনিময় করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে দলটির স্থায়ী কমিটি। ইতোমধ্যে স্থায়ী কমিটির একাধিক সদস্যের সমন্বয়ে বিভিন্ন ভাগে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে মতবিনিময় করার সিদ্ধান্ত এসেছে।

বিএনপির প্রভাবশালী নেতারা জানান, ঈদুল আজহার পর বিভিন্ন পরিসরে কেন ডিসেম্বরে নির্বাচন প্রয়োজন তা নিয়ে আরও বেশি জনসম্পৃক্ত অবস্থান তৈরি করতে চায় বিএনপি। পৃথিবীতে কোন কোন দেশে অন্তবর্তী সরকার আসার পর পরবর্তী সময়ে ক্যু হয়েছে, গৃহযুদ্ধ হয়েছে, সেই নিরিখে পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করার চিন্তা করছেন বিএনপির নেতারা। এ বিষয়টি অন্যান্য রাজনৈতিক দলের ক্ষেত্রে সমানভাবে প্রতিফলিত করতে চান দলটির নেতারা।
কোনও কোনও নেতা জানান, অন্তবর্তী সরকার যত বেশি সময় থাকবে, দেশের অর্থনীতি, বেকারত্ব, দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ না হওয়াসহ নানা ধরনের সংকট সামনে তত আসবে।
ইতোমধ্যে বিএনপির সিনিয়র নেতাদের পক্ষ থেকে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে কথা বলা শুরু হয়েছে বলে বিভিন্ন দলের নেতাদের সঙ্গে আলাপকালে জানা গেছে। তারা জানান, ঈদের পর বিভিন্ন ভাগে দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করবে বিএনপি।
একাধিক দলীয় প্রধান বলেন, ‘নির্বাচন ইস্যুতে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে আরও বেশি ঐক্য স্থাপন করা মতবিনিময়ের মূল লক্ষ্য।’ জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, ‘আমরা তো মনে করি, ডিসেম্বরের আগেই নির্বাচন হওয়া উচিত। কোন যুক্তিতে একেক দিন যাচ্ছে? একেকটা দিন অতিবাহিত হওয়ার জন্য তো ১৫ বছর আমরা যুদ্ধ করিনি। গণতন্ত্রের জন্য, জনগণের মালিকানা জনগণের হাতে তুলে দেওয়ার জন্য রাজনৈতিক দলগুলো সংগ্রাম করেছে।’
‘এক দিনও যাবে কেন। ডিসেম্বরে যাবে কেন। ৯০ শতাংশ রাজনৈতিক দল ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন দাবি করছে।’ উল্লেখ করেন আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী। তিনি বলেন, ‘নির্বাচনি ঐক্যমত্য ইতোমধ্যে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। যারা নির্বাচন পেছাতে চায়, যারা নির্বাচন চায় না তারা কারা। তারা তো অনেকে নিবন্ধিতও না। দেশের মানুষ গণতান্ত্রিক, সাংবিধানিক ও রাজনৈতিক অধিকারকে কারা বাধাগ্রস্ত করছে, এখন তো সেগুলোও বেরিয়ে আসবে। কেন বাধাগ্রস্ত করছে, সেটাও আসবে।’
রহস্য ‘ডিসেম্বর-জুনে’ : কোনও কোনও নেতার ভাষ্য, প্রধানত তিনটি কারণে নির্বাচন ইস্যুতে অন্তবর্তী সরকার স্পষ্ট অবস্থানে যাচ্ছে না। প্রথমত: সরকার ছাত্রদের নতুন দল, একাধিক ধর্মভিত্তিক দলকে সংগঠিত হওয়ার সুযোগ করে দিতে চায়, যারা সরকারকে নানাভাবে প্রত্যক্ষ সহায়তা করছে।
দ্বিতীয়ত: ড. মুহাম্মদ ইউনূস ও তার সরকারের ভেতরে প্রভাবশালীদের মধ্যে বিভিন্ন এজেন্ডা রয়েছে, সেগুলো বাস্তবায়নে আরও বেশি সময় প্রয়োজন। এরমধ্যে সমুদ্রবন্দর, করিডর ও স্টারলিংকসহ আরও কিছু বিষয়।
তৃতীয়ত: ক্ষমতায় আরও বেশি সময় থাকতেই অন্তবর্তী সরকারের দায়িত্বশীলরা ডিসেম্বর থেকে নির্বাচন আরও পিছিয়ে আগামী বছরের মাঝামাঝি নিতে আগ্রহী।
গণতন্ত্র মঞ্চের অন্যতম একজন নেতার সন্দেহ, ‘নির্বাচন নিয়ে রোডম্যাপ দিলেও সন্দেহের অবসান হয়। কিন্তু সরকার তা করছে না। এতে করে আরও সন্দেহ সৃষ্টি হচ্ছে।’
জানতে চাইলে গণতন্ত্র মঞ্চের অন্যতম নেতা সাইফুল হক বলেন, ‘বাংলাদেশ এখন অনিশ্চিত যাত্রায়। দেশে নানামুখী সংকট কাজ করছে। নির্বাচন যত বেশি দেরি হবে, নৈরাজ্য, অচলাবস্থা আরও বাড়বে। কোনও কোনও বিদেশি রাষ্ট্র এই সরকার আসার পর থেকে তাদের অবস্থানের কোনও পরিবর্তন আসেনি। দেশে পুশইন অব্যাহত রয়েছে। সব মিলিয়ে বাংলাদেশ অনিশ্চিত পথে যাত্রা করতে পারে না।’
বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হকের অভিযোগ, ‘সরকারের জবাবদিহি নেই। সরকারের মধ্যকার লোকদের মধ্যে অনেকটাই লটারি পাওয়ার মতো অবস্থা। আমি দেখছি, সরকারের ভেতরে আরও সরকার রয়েছে। আমি সেদিনও প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সামনে বলেছি আমরা আপনার নেতৃত্বে একটা সরকার দেখতে চাই।’
বিএনপির উচ্চ পর্যায়ের নেতা ও দায়িত্বশীলদের সঙ্গে আলাপকালে জানা গেছে, প্রধান উপদেষ্টার ‘ডিসেম্বর থেকে জুনের মধ্যে নির্বাচন’ এবং সেনাপ্রধানের ‘ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন’ এই দুটো বক্তব্যের মধ্যে মূল রহস্য রয়েছে। একইসঙ্গে বিএনপি কার্যকরভাবে ঠিক কোন পক্ষের সঙ্গে যুক্ত, তা নিয়ে খোদ দলের অভ্যন্তরেও প্রশ্ন রয়েছে।
সিনিয়র নেতারা এ প্রসঙ্গে এই প্রতিবেদকের সঙ্গে আলাপকালে স্পষ্ট কিছু জানাতে পারেননি। দলটির উচ্চ পর্যায়ের কয়েকজন নেতা আলাপকালে জানান, মূলত ডিসেম্বর ও জুন নির্বাচনের সম্ভাব্য এই সময়ের মধ্যেই রহস্য নিহিত রয়েছে।
বিএনপি কোন পথে : তবে কোনও কোনও রাজনীতিক মনে করছেন, ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বেই নির্বাচনের পক্ষে বিএনপি। তবে এক্ষেত্রে সময়সীমা নিয়ে দৃশ্যমান চাপাচাপি কার্যকর কোনও দিকে টার্ন করলে পরিস্থিতি ভিন্ন দিকে যেতে পারে। এক্ষেত্রে প্রধান উপদেষ্টার পদত্যাগের কানাঘুঁষাটি বাস্তবে কোনও চেহারা পেতে পারে।
‘এক্ষেত্রে আশঙ্কা করা হচ্ছে, পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে বিগত ক্ষমতাসীনদের পক্ষে সুবিধা যেতে পারে। এ বিষয়টিও বিএনপির শীর্ষ পর্যায়ে আলোচনায় রয়েছে। একইসঙ্গে বিএনপিকেও সমানভাবে দুটো পক্ষ সামলাতে হচ্ছে।’
ডিসেম্বর বা জুন, এই সময়কে কেন্দ্র করে অন্তবর্তী সরকারের সঙ্গে কোনও বিরোধ তৈরি হতে পারে কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, ‘এটা যদি ঘটে খুবই দুর্ভাগ্যজনক হবে।’
একই প্রশ্নের জবাবে গণতন্ত্র মঞ্চের নেতা সাইফুল হকের ব্যাখ্যা, ‘নির্বাচন দেরিতে হলে অগণতান্ত্রিক শক্তি উৎসাহ পাবে। তাদের জমিন বাড়ে, উর্বর হয়ে উঠে।’
তিনি বলেন, ‘আমরা সরকারকে সহযোগিতা করতে চাই। কিন্তু পরিস্থিতি বলছে যত দিন যাচ্ছে তত অসম্মানিত হচ্ছেন। দেশও অনিশ্চিত পথে যাচ্ছে।’
নির্বাচন আদায়ের ইস্যুতে বিএনপি কোনও কর্মসূচি দেবে কিনা, এমন প্রশ্নের জবাবে দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু বলেন, ‘কর্মসূচি সম্পর্কে আমরা এখন কিছু ভাবছি না। কর্মসূচির আগে অনেক কাজ বাকি আছে।’